Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে!

Icon

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১৭

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে!

এই শীতেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসবে বলে জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে এমন যুক্তিও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। 

আবার অনেক এপিডেমিওলজিস্ট বলছেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, শীতের সাথে নতুন করে করোনা সংক্রমণের কোনো সম্পর্কও নেই। তাদের কথায় যুক্তি থাকলেও এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য ও গ্রাফ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেয়। 

তবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউই থাকুক, অথবা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হোক, উভয় ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে না চলার কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা ও সতর্ক জীবনযাপন করতেই হবে যতক্ষণ ভাইরাসটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসছে।

বাংলাদেশে এখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনালগ্ন চলছে বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে এটা অনেকটা নিশ্চিত।’

করোনা সংক্রমণের গ্রাফের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘মহামারির ওয়েভ বা ঢেউ হচ্ছে সংক্রমণ বিস্তারের একটি ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন বা চিত্র। তথ্যের দিকে না তাকিয়ে শুধু গ্রাফ বা চিত্রের দিকে তাকিয়েই বলে দেয়া যায় একটা নির্দিষ্ট সময় ভাইরাস সংক্রমণ বেড়েছে, না-কি কমেছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন কতজন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে এর ওপর ভিত্তি করে যে গ্রাফ অঙ্কন করা হয়, তা দিয়ে ওয়েভের ধরনটি বোঝা যায়। ওই গ্রাফে সংক্রমণের সংখ্যা অবশ্যই লিনিয়ার বা প্রকৃত সংখ্যা হতে হবে, লগারিদমে রূপান্তরিত সংখ্যা দিয়ে ওয়েভ বোঝা যাবে না। সুতরাং কোনো গ্রাফে সংক্রমণের ওয়েভ প্যাটার্ন বুঝতে হলে প্রথমে লক্ষ্য করতে হবে গ্রাফটি কি লিনিয়ার স্কেলে নাকি লগারিদমিক স্কেলে আছে। একটি মহামারির ওয়েভে তিনটি অংশ থাকে- আপ স্লোপ বা উন্নতির ঢাল, পিক বা চূড়া ও ডাউন স্লোপ বা অবনতির ঢাল। প্রতিদিন যখন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন তা ‘উন্নতির ঢাল’ তৈরি করে। এভাবে বাড়তে বাড়তে একটি সময় সংক্রমণ আর বাড়ে না, তখন গ্রাফের ওই অবস্থাকে বলা হয় চূড়া। এরপর প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা আবার কমতে থাকলে অবনতির ঢাল তৈরি হয়। এভাবেই তৈরি হয় মহামারির একটি পূর্ণ ওয়েভ।’

ড. আকরাম বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের করোনাভাইরাস মহামারির ওয়েভের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েভ ভালোভাবেই দৃশ্যমান। প্রথম ওয়েভটি শুরু হয় মার্চের মাঝামাঝিতে ও শেষ হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে। এরপর দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয় আগস্টের শেষে যা পিকে পৌঁছে মধ্য নভেম্বরে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ওয়েভের অবনতির ঢাল। ২ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের আদেশে লকডাউনের কারণে এমনটি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, সেখানে করোনাভাইরাসের তিনটি ওয়েভ দৃশ্যমান। প্রথম ওয়েভটি বিস্তৃত মধ্য মার্চ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় ওয়েভের শুরু হয় ১৮ জুনে এবং শেষ হয় ৯ সেপ্টেম্বর। তৃতীয় ওয়েভটি শুরু হয় অক্টোবরের শুরুতে, যা এখন চূড়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই তৃতীয় ওয়েভেই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ দৈনিক মৃত্যু তিন হাজার ১০০ জন রেকর্ড করা হয় গত ৪ ডিসেম্বর।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের গ্রাফের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, প্রথম ওয়েভই শেষ হয়নি, তাহলে দ্বিতীয় ওয়েভ এলো কোথা থেকে? বাংলাদেশে প্রথম ওয়েভের সূচনা ১০ এপ্রিল। এরপর থেকে প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে সমানুপাতিক হারে, যা পিক বা চূড়ায় পৌঁছে ২ জুলাই ও তারপর থেকে সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষে গিয়ে সংক্রমণের এই ক্রমাবনতি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে। আর এভাবেই প্রথম ওয়েভটি সম্পন্ন হয়। এরপর অক্টোবরের শেষ থেকে সংক্রমণের সংখ্যা আবার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং সূচনা করে দ্বিতীয় ওয়েভটির। বাংলাদেশে মহামারিটি এখন দ্বিতীয় ওয়েভের উন্নতির ঢালে অবস্থান করছে। ঠিকমতো টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো গেলে হয়তো দ্বিতীয় ওয়েভটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। বাংলাদেশ এখন মহামারির দ্বিতীয় ওয়েভের সূচনালগ্নে রয়েছে। অন্যদিকে ভারতে মহামারিটি এখনো প্রথম ওয়েভেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।’

এ মতের বিপরীত মতও রয়েছে অনেকের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে তো প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি। বর্তমানে যা চলছে, তা প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে কিছুটা যোগ করেছে। যখন সংক্রমণের সংখ্যা ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে, তখনই বলা যাবে যে প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং সংক্রমণ ৫ শতাংশ থেকে আবার ধীরে ধীরে উঠে আগের ১৫-২০ শতাংশে পৌঁছলে তখন বলা যাবে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে; কিন্তু বাংলাদেশে সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে কখনো নামেনি। সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত নেমেছিল এবং তা থেকে কিছুটা বেড়েছে। গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দেশে করোনা সংক্রমণ ছিল মোট নমুনা পরীক্ষার ১৬.৬৭ শতাংশ এবং ৭ ডিসেম্বর একদিনের নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে সংক্রমণ ছিল ১৫.৩০ শতাংশ।’ 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীরও বলছেন, ‘বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি।’ 

তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, প্রথম ঢেউ অথবা দ্বিতীয় ঢেউ বিতর্কে কিছু আসে যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চলছে। এ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা কেউ নিরাপদ নই। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ভ্যাকসিনই একমাত্র পথ। ব্রিটেন ৮ ডিসেম্বর থেকে ভ্যাকসিন দিতে শুরু করেছে। অবশিষ্ট উন্নত দেশগুলো চলতি ডিসেম্বরের মধ্যেই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়তো শেষ করবে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসতে কিছুটা দেরি হতে পারে। কারণ সরকার একমাত্র অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কেনার একটি প্রাথমিক চুক্তি করেছে। তাও বেসরকারি বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে। বেক্সিমকো ফার্মা চুক্তি করেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে। এখনো অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করেনি। কারণ এই কোম্পানির তৃতীয় দফা ট্রায়ালে ত্রুটি ছিল এবং তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। তাদের গবেষকরা অবশ্য বলছেন, দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন দেয়ার পর এর কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাবে। তবে ইতিমধ্যে এই কোম্পানিটি তৃতীয় দফার আরেকটি ট্রায়াল করতে যাচ্ছে। 

গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ব্রিটেন ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি ভ্যাকসিন দিতে শুরু করছে তাদের নাগরিকদের। ভ্যাকসিনটি ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হলেও এটির জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজার। কারণ এই ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেফ্রিজারেটরের প্রয়োজন। আর এই টিকা সংরক্ষণের জন্য ব্রিটেন ইতিমধ্যে নতুন ধরনের রেফ্রিজারেটরও উৎপাদন করেছে। এটি খুবই কার্যকর একটি টিকা হলেও বাংলাদেশে এই টিকা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। 

ফলে বায়োএনটেক-ফাইজারের টিকা হয়তো আমরা পাচ্ছি না, যদি সরকার বাইরে থেকে বিশেষভাবে ক্রয়াদেশ দিয়ে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ক্ষমতা সম্পন্ন রেফ্রিজারেটর না আনার ব্যবস্থা করে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের তৈরি বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী হবে। এরই মধ্যে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি এ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। এই কোম্পানির ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা সাধারণ ফ্রিজেই রাখা যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫