Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় তসলিম উদ্দিনের পরিবার

Icon

এম ওবাইদুল্লাহ

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:৫৮

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় তসলিম উদ্দিনের পরিবার

১৯৭১ সাল। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪টায় অ্যাডভোকেট তসলিম উদ্দিন তখন নগরীর কাজিহাটার নিজ বাসায় ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে বোয়ালিয়া থানা পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কয়েকজন সেপাই ও ইপিকাপের সদস্যদের নিয়ে তাদের বাসায় আসেন।

কিছুক্ষণের জন্য থানায় যেতে হবে বলে তসলিম উদ্দিনকে থানায় নিয়ে যান ওসি। রমজান মাস। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে ইফতারের আগেই ছেড়ে দেবেন বলে জানান।তসলিম উদ্দিন তাদের সঙ্গে থানায় যান। অবশ্য না গিয়ে তার উপায়ও ছিলো না।

এসময় পরিবারের সকলেই শঙ্কিত ছিলো তার ফিরে আসা নিয়ে। অবশেষে যা হবার তাই হলো। তিনি আর ফিরে এলেন না আপনজনদের মাঝে। থানায় নিয়ে গিয়ে তাকে বলা হলো, জোহা হলে যেতে হবে। তাকে যে ক্রমাগত হায়েনার খাঁচার ভিতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এ কথা তিনি তখনই বুঝেছিলেন।

থানায় ইফতার নিয়ে এলে শ্বশুর ও ছোট ভায়ের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাত হয়। এর কিছুক্ষণ পর বাসায় ফোন করে স্ত্রী অধ্যাপিকা সাঈদা বেগমকে জানান, আমি মিলিটারিদের সঙ্গে জোহা হলে যাচ্ছি। ওদের কর্নেল আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যতই রাত হোক ওরা আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে।

এই ছিলো স্ত্রীর সঙ্গে তসলিম উদ্দিনের শেষ কথা। ইফতারের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জোহা হলে। সেখানে তাকে সাবেক মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের বাবা, চাচা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে একই কক্ষে বন্দি করে রাখে। এরপরের খবর কেবল নিগ্রহের।

১৭ নভেম্বর আর সব বন্দিদের সঙ্গে পিঠমোড়া করে তাকে নিয়ে যায় জল্লাদ খানায়। তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে গণকবরে মাটি চাপা দেয় হায়েনারা। তসলিম উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাবার পর তাকে উদ্ধারে সব ধরণের চেষ্টা করেছেন স্ত্রী অধ্যাপিকা সাঈদা বেগম ও ছোট ভাই অ্যাডভোকেট গোলাম রাব্বানী।
 
শত অনুনয়-বিনয়েও সেদিন আপনজনদের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারেনি তাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন অধ্যাপিকা সাঈদা বেগম। তবুও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশা ছাড়েননি।

তিনি জানান, স্বাধীনচেতা এ মনুষটির একটিই অপরাধ-তিনি এ দেশকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন দেশের মানুষকে। আত্রাই থেকে আসা যুদ্ধাহত আত্মীয়দের রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে তাদের খোঁজখবর নিতেন তিনি। তখন তিনি কর্মক্ষেত্র আয়কর বারে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তৈরি করছিলেন জনমত।

মার্চে পুলিশ লাইনে পাকিস্তানিদের বর্বর হামলায় প্রাণ যায় বহু বাঙালি পুলিশ সদস্যের। বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া আহতদের আর্তনাদ ব্যথিত করে তাকে। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সারা বাংলাদেশ তখন জ্বলছে।

অথচ স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার এ মানুষটি জীবন বাঁচাতে তখনো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেননি। দেশমাতৃকার টানে আবারো ফিরে এলেন সীমান্তবর্তী অখ্যাত গাঁও নবাবজাগি থেকে। তার এ ফেরা প্রথম ফিরে আসা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শহীদ তসলিম উদ্দিনসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে অনেক।

ডাক বিভাগ বিশেষ ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছে। সবখানেই সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে তার নাম। তবে সময়ের আবর্তে তাতেও ভাটা পড়েছে বলে শহীদের স্ত্রী অধ্যাপিকা সাঈদা বেগম জানান।

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেরও এ বীর শহীদের পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে জোর তদবির করেও বিফল হয়েছেন তারা। এমনকি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মৃত্যু রেজিস্টারের এ শহীদের নামের পূর্বে ‘শহীদ’ শব্দটিও স্থান পায়নি।

পুরনো ছবির ফ্রেমে জমেছে ধুলো। বিষণ্ণ দুপুর গিয়ে থেমেছে রঙ চটা বিকেলে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জাতির জনকের পাঠানো হাতে লেখা একটি শোকবার্তাই কেবল এখন সম্বল এ পরিবারটির। এত কিছুর পরও আশা জিইয়ে রেখেছেন শহীদের স্ত্রী অধ্যাপিকা সাঈদা বেগম।

চশমা, কলমসহ আরো দুদএকটি জিনিস অবশেষে ফিরে পেয়েছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী অ্যাডভোকেট তসলিম উদ্দিনের পরিবার। এ তার দ্বিতীয় ফেরা। দেশ স্বাধীন হবার কয়েক দিন পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ড. শামশুজ্জোহা হলের পিছনের গণকবর থেকে উদ্ধার হওয়া পঞ্চাশটির বেশি গলিত মরদেহের ভিতর সেদিন এ শহীদকে আপনজনরা সনাক্ত করতে পারেনি। জোহা হলের সেই জল্লাদ খানা থেকে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া লোকদের ভাষ্য মতে, ১৭ নভেম্বর রাতেই তাকে আর সব বন্দিদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫