
ফাইল ছবি
নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই রোহিঙ্গাদের একটি দলকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে ছয় শতাধিক পরিবারের ২৭০০ রোহিঙ্গাকে এই চরে স্থানান্তর করা হয়।
প্রশ্ন হলো- এই স্থানান্তরের ভবিষ্যৎ কী এবং এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি আরো বিলম্বিত হবে কি-না?
প্রসঙ্গত, দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে যে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার বাঁধ দেয়া হয়েছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সেখানে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর পালন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে যেন এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারেন, সে লক্ষ্যে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি।
যদিও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কড়া সমালোচনা করছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের যুক্তি, শরণার্থীদের অবহিতপূর্বক পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে। ভাসানচরের ভেতরে-বাইরে তাদের চলাচলের স্বাধীনতা থাকতে হবে। জাতিসংঘের আবাসিক দফতরের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের বরাতে সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের তরফে কোনো ধরনের জোর করা হয়নি। স্বেচ্ছায় যারা যেতে চাইছেন, শুধু তাদেরই সেখানে পাঠানো হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো- রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়ার বাইরে জাতিসংঘ এই বিরাট সমস্যা সমাধানে কী করেছে বা করতে পেরেছে? এতদিনেও রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তারা কার্যত কিছুই করতে পারেনি বা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়াগেও ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং তারা এখন রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে কেন- এ প্রশ্নও উঠেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের প্রশ্ন, ‘রোহিঙ্গাদের তারা কেন আমেরিকা-ইউরোপে নিয়ে যাচ্ছেন না? সাড়ে তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থা চেষ্টা করছে, একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে পাঠাতে পারেনি। রাখাইনে কী হচ্ছে, তারা সেটা মিয়ানমারের কাছ থেকে কেন জানতে পারছে না।’
এটিই বাস্তবতা যে, মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের শিকার হলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে এবং এর ফলে প্রধান ভিকটিম হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ জাতিসংঘের মতো সংস্থা এই ইস্যুতে যা করেছে, তার ফলাফল এক অর্থে শূন্য। শুধু রেজুলেশন বা প্রস্তাব পাস কিংবা বাংলাদেশের মানবিকতার ভূয়সী প্রশংসা ছাড়া এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা কী করেছে বা করতে পেরেছে, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। কেন পারেনি, সেটি আরো বড় প্রশ্ন। কারণ মিয়ানমারের সাথে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ রয়েছে। অন্যদিকে এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ শক্তি ভারতের ভূমিকাও নীরব। অর্থাৎ তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যত বাংলাদেশের পক্ষে নেই। আবার সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষেও নেই। বৃহৎ শক্তিবর্গের এই অবস্থানও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বড় ধরনের অন্তরায়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে- বাংলাদেশে যে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো খুব কঠিন ও সম্ভবত অসম্ভবও।
দেশের অগণিত মানুষ এখনো গৃহহীন। বিশেষ করে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় গৃহহীন অনেক মানুষ এখনো বেড়ি বাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ ভিন দেশের রোহিঙ্গাদের মানসম্মত বসবাস নিশ্চিতে ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটি বিশ্বের যে কোনো দেশের শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের জন্য একটি বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু তারপরও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে। অথচ কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচর বহুলাংশে নিরাপদ। কক্সবাজার ও ভাসানচরের মধ্যে পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, সেখানে বিমানবন্দর নেই, পাঁচতারকা হোটেল নেই, কক্সবাজারের মতো দীর্ঘসমুদ্র সৈকতসহ বিনোদনের অন্যান্য ব্যবস্থা নেই যে, বিদেশ থেকে এনজিওর কর্তারা রাজধানী ঢাকা থেকে বিমানে এখানে এসে নামতে পারবেন এবং পাঁচতারকা হোটেলে গিয়ে থাকতে পারবেন। কারণ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতার মূল কারণ হিসেবে যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে, সেই বিবেচনায় কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচর অনেক বেশি উন্নত। কিন্তু তারপরও কেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন কক্সবাজারকে ডেঞ্জার জোন মনে করেন। সে কারণে তারা প্রতিদিন সাড়ে চারশ’ ডলার পান। ভাসানচরে গেলে সেই টাকা পাবেন না। খরচ বেঁচে যাবে।’
তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ সরকারের হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ভিকটিম হতে হবে বাংলাদেশকেই। কেননা, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য যে ধরনের ঘর, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি এমনকি সন্তানদের পড়ালেখার ব্যাপারেও যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গারা সেখানে স্থায়ী নাগরিক হিসেবেই থেকে যেতে চাইবে। ভবিষ্যতে তাদের কেউই মিয়ানমারে ফিরতে চাইবে না। কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই যেখানে মিয়ানমারে ফিরতে চায় না, সেখানে ভাসানচরের মতো জায়গায় সুন্দর ঘরবাড়ি আর চাষাবাদের সুযোগ পেয়ে তারা কেন এমন একটি জনপদে যেতে চাইবে যেখানে প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যু, নির্যাতন, ধর্ষণের মতো ঝুঁকি রয়েছে? উপরন্তু এটি মিয়ানমারকেও সুযোগ করে দিয়েছে। তারা হয়তো ভবিষ্যতে বলবে, ‘বাংলাদেশ তো রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে নিয়েছে।’
মুশকিল হলো- ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের এই প্রকল্পটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলে ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের আরো বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গাদের জন্য এরকম বসবাসের ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে- যা আখেরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অধিকতর বিলম্বিত ও জটিল করে তুলবে। কেননা ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
অথচ দেশে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা আছে ১১ লাখেরও বেশি। দীর্ঘমেয়াদে তাদের কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখার ফলে এরই মধ্যে পর্যটনসমৃদ্ধ ওই এলাকার অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে, যা পুষিয়ে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে যদি সত্যিই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না যায়, তাহলে তাদের ভাসানচরের মতো আরো বিভিন্ন জায়গায় হয়তো স্থানান্তর করতে হবে। এর মধ্যে অনেকেই অতীতের মতো বাংলাদেশের মূল স্রোতধারায় মিশে যেতে চাইবে বা মিশে যাবে। রাজনীতিবিদদের অনেকে এই জনগোষ্ঠীকে ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার চেষ্টাও করবেন। অনেক উগ্রবাদী সংগঠন এই জনগোষ্ঠীর তরুণদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করবে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রহীন এই নাগরিকরা যত বেশি সংখ্যায় ও যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, বাংলাদেশের বিপদ তত বাড়বে।
যে মানবিকতার কারণে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, সেটি এক সময় দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সুতরাং, ভাসানচর কিংবা অন্য কোথাও স্থানান্তরের চেয়েও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ইস্যু- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো তথা এই জনগোষ্ঠীকে ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা- সেই জায়গায় খুব বেশি কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানাজনের নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির আছে।