শহীদ ডা. মিলন হত্যা: ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল খুনী

রহমান জাহিদ
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:০১

ডা. মিলন
ডা. মিলন- পুরো নাম শামসুল আলম খান মিলন। ডা. মিলন নামেই তিনি আজ গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সবার মাঝে বেঁচে আছেন। তিনি একজন সাহসী প্রগতিশীল রাজনীতিক ছিলেন। গণমুখী স্বাস্থ্যসেবা গড়তে নাম লেখান সমাজ বদলের রাজনীতিতে।
চিকিৎসা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ রুখতে যোগ দেন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। বারবার হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও তাকে দমাতে পারেনি সরকার। বরং প্রতিবারই বিপুল উদ্যমে ফিরে এসে শামিল হন জনতার কাতারে। অঙ্গীকারের প্রতি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাই কাল হয়ে ওঠে।
১৯৯০ সালের এই দিনে স্বৈরাচারের বাহিনীর বুলেট খুঁজে নেয় ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। তার রক্তের স্রোতে এরশাদের পতন হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রের পথযাত্রা নতুন রূপ লাভ করেছিল। দেশের মানুষের কল্যাণে এমন জীবনদান ভবিষ্যতের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
কিন্তু ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর বেলা ১১টায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-মহাসচিব ডা. শামসুল আলম খান মিলন যখন সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের চোরাগোপ্তা গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারসংলগ্ন রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন, তখন কি তিনি ভেবেছিলেন তার হত্যার বিচার শেষে দেখা যাবে যে, তার কোনো হত্যাকারী নেই? মিলন হত্যার জন্য কারও কোনো শাস্তি হয়নি। শুধু একজনকে অবৈধভাবে অস্ত্র রাখার জন্য এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তাহলে মিলনকে গুলিটা কে করল? ঘাতক কে ও তার নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হলো না কেন? মিলন হত্যার ৩০ বছর পার হলেও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচার করা যায়নি।
কিন্তু তরুণ চিকিৎসক মিলনকে কেন টার্গেট করেছিল সামরিক সরকার? ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মা সেলিনা আখতার বলেন, তাকে অনেকবার সরকারি দলে যোগ দেয়ার জন্য বলা হলেও সে তা গ্রহণ করেনি। রংপুরে কোনো পোস্ট নেই, তারপরও তাকে রংপুরে পোস্ট দেয়া হয়েছে। তাকে চাকরি থেকে একবার বরখাস্তও করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় তাকে সরকারের নির্যাতনমূলক শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট জন্ম নেয়া ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মা সেলিনা আখতার জানান, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও এ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি (ব্যাচ কে-৩৪) অর্জন করেই জড়িয়ে পড়েন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। এ অপরাধে অন্যায়ভাবে তাকে রংপুরের রৌমারীতে বদলি করা হয়। তখন সরকারের কেউ কেউ তাকে দেখে নেয়ারও হুমকি দেন। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ২৭ নভেম্বর পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসপাতাল) বিএমএর আন্দোলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে সকালে আজিমপুরের বাসা থেকে বের হন মিলন। সেই আন্দোলনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ডা. শামসুল হক মিলন।
সেলিনা আখতার বলেন, ইডেন মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ছিলাম আমি। আজিমপুর কোয়ার্টারে আমার সঙ্গেই থাকত মিলন, তার স্ত্রী মাহমুদা শিকদার ও একমাত্র কন্যা শামা বিজয়া আলম। মিলনের স্ত্রী মাহমুদা শিকদার বিচারের আশায় ছিলেন বহুদিন। এক সময় এক রাশ হতাশা নিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। বর্তমানে তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। মিলনের একমাত্র কন্যা শামা বিজয়া আলম থাকেন ওয়াইহোতে। সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে পড়ছেন।
সেলিনা আখতার বলেন, তার ছেলের হত্যার বিচার না হওয়ায় তিনি লজ্জিত বোধ করেন। জাতি হিসেবে বিবেক বিবর্জিত মনে হয়। তার প্রশ্ন, এই হত্যার বিচার করতে সরকারগুলো কেন ব্যর্থ হলো, কাদের স্বার্থে এই ব্যর্থতা? শহীদের আত্মা কি তাদের ক্ষমা করবে?
করোনাভাইরাস মহামারিকালে ডা. মিলনের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক। ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মা সেলিনা আখতার বলেন, এই করোনাকালে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতটা কতটা নাজুক; কিন্তু মিলনের স্বপ্ন এটা ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল গরিব মানুষের দ্বারে দ্বারে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়া। সত্যিকারের গণতন্ত্র এবং গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল তার সন্তানের রক্তদান স্বার্থক হবে।
মিলন হত্যার মামলার বাদী ছিলেন তার সহকর্মী ডা. মুশতাক হোসেন।
শহীদ ডা. মিলন সংসদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এরশাদ চেয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দোষ ছাত্রদের ওপর চাপাবে। সে স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে কারফিউ জারি করার কথাও বলেছে। তার মানে এটি একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে মিলন হত্যার দায়সারা তদন্তের কারণে সাজা হয়নি হত্যাকারী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের। এমনকি আজও সাড়া মেলেনি পুনঃতদন্তের আবেদনেও।
মুশতাক হোসেন বলেন, মামলার পর ঢাকার একটি আদালত রায় ঘোষণা করেন; কিন্তু রায়ে তখনকার দু’জন ডাকসাইটে ছাত্রনেতাসহ কয়েকজনকে মামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়নি মর্মে খালাস দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে বিচারিক আদালতে মিলন হত্যা মামলার রায় দেয়ার পর অ্যাডভোকেট শামসুল হক চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি) মিলনের মায়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে মিলন হত্যা মামলাটির পুনঃতদন্ত ও পুনর্বিচারের আবেদন জানিয়েছিলেন। আজ পর্যন্ত তার কোনো ফলাফল জানা যায়নি।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে অবৈধ এরশাদ সরকারের শেষ দিনগুলোতে রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের জন্য বরাদ্দকৃত গুলির একটা বড় অংশের কোনো হিসাব পরবর্তী সরকারের সময় পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ওই সময় সামরিক বাহিনীতে কর্মরত জেনারেল আইনুদ্দিন।
২০০৯ সালে একটি দৈনিক পত্রিকা ও একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে এ তথ্য প্রকাশ করে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর এরশাদ যে দুর্বৃত্তদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের ওই গুলি সরবরাহ করা হয়ে থাকতে পারে। এটা অনেক দিন ধরে অভিযোগ করা হচ্ছিল যে, ওই সময় সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসার নাম করে কোনো কোনো দুর্বৃত্তকে আনা হয়েছিল এবং তাকে বা তাদের টিফিন কেরিয়ারে করে গুলি সরবরাহ করা হয়েছিল। যেসব সামরিক কর্মকর্তা ওই গুলি খোয়া যাওয়ার জন্য দায়ী তাদের ১৯৯০-পরবর্তী সরকার সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু মিলন হত্যার সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা তদন্ত করে দেখা হয়নি। কার নির্দেশে ওই গুলি দুর্বৃত্তদের সরবরাহ করা হয়েছিল তারও কোনো তদন্ত ও বিচার হয়নি। মিলন হত্যার পুনঃতদন্ত হলে এসব অজানা ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা আইনজীবী ডা. মুশতাক হোসেনের।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তিন দশক পার হলেও এখন পর্যন্ত ডা. মিলনের হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। অথচ নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলোর অঙ্গীকার ছিল মিলন হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করার। নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলো মিলনের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তারা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সুফল ভোগ করে আসছে। অথচ তাকে শহীদের উপযুক্ত মর্যাদাটুকু দেয়নি।