
রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি কোনো নির্বাচন কমিশনই (ইসি)। তবে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি রাজনৈতিক বিতর্ক ছাড়াও বিভিন্ন বিতর্কের চাদরে আবৃত ও প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের আচরণ ও কার্যক্রম নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু নয়, খোদ ইসির জ্যেষ্ঠ কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
এখন ইসির বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়মের সাথে জড়িত, অসদাচরণকারী, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের রক্ত ও বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছেন দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে এই ইসি অপসারণে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকাদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের রাষ্ট্রপতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানানোর এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি।
রাষ্ট্রপতিকে দেয়া বিশিষ্টজনদের ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে ও তার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।’
ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘আপনি আরো অবগত আছেন যে, আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। ১১৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করবেন সেইরূপ হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতিতে ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না।
নূরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন। যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন বলে আমরা মনে করি। আমরা আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মসহ কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের অন্য কয়েকটি ক্ষেত্র আপনার সদর অবগতির জন্য চিহ্নিত করছি।’
ইসির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থ সংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণ তিনটি হলো- বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার নামে ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
এছাড়া অন্যান্য গুরুতর অসদাচরণ ও ছয়টি অনিয়ম হলো- ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
চিঠিতে বিশিষ্টজনরা বলেন, ‘গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার লক্ষ্যে আপনাকে বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। একইসঙ্গে অন্যান্য অসদাচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ও প্রমাণ সাপেক্ষে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণ করার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের অভিযোগের বিষয়ে আপনাকে সামনাসামনিভাবে অবগত করার জন্য আপনার সুবিধামতো সময়ে একটি সাক্ষাতের আয়োজনের জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।’
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক সি আর আবরার, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্রতির শারমিন মুরশিদ, অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির প্রমুখ।
তবে এসব অভিযোগ অসত্য, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।
এই কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে আপত্তি ছিল। তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও) সংশোধনীর উদ্যোগ নেন, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজে আপত্তি ওঠে। তারপরও তারা সেই কাজ অব্যাহত রাখে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯১(ই) ধারায় কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের সরাসরি ক্ষমতা, যা নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত ছিল। তার বিলোপ সাধন করে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন ২০২০’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে ইসি। নির্বাচন কমিশনের এ জাতীয় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থেকে তার ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নিজেদের অযোগ্য মনে করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সকল কমিশনারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সুশীল সমাজের মতামতকেও তারা আমলে নেননি।
আরপিওর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইনের (২০২০) বিরোধিতা করে কমিশন সভায় আবারও নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্ন মত) দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’-এর চ্যাপ্টার সিক্স ‘এ’-এর বিভিন্ন আর্টিকেল কর্তন করে রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন, ২০২০ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি এই সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। আরপিও বা ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’-এর অংশবিশেষ নিয়ে পৃথকভাবে আইন প্রণয়ন হঠকারী সিদ্ধান্ত। আমি পূর্বেও বলেছি, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ একটি ঐতিহাসিক আইনগত দলিল, যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার অনন্য স্মারক। নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব গৃহীত হলে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’-এর অঙ্গহানি ঘটবে। যাতে একে বিকলাঙ্গ মনে হবে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।”
তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভোটের আগের রাতেই ব্যালেট বক্সে পেপার ভর্তির অভিযোগ। আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে আমাদের সংবিধানে কমিশনকে আইন ও বিধি-বিধানের সঙ্গে প্রয়োজনে সংযোজন করারও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যে ক্ষমতা মূলত নির্বাচিত সংসদের। উপরন্তু নির্বাচনের সময়ে কোনোরূপ কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতাও আমাদের উচ্চ আদালত কমিশনকে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার-অনেক গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও শুনিনি।’
সম্প্রতি উপ-নির্বাচনের সময় মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, ‘উপ-নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমার ধারণা হয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচন আরো নিচে নেমে গেছে। নির্বাচন মোটেই অংশগ্রহণমূলক হয়নি। কেন্দ্রে বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট আমি দেখিনি।’
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এই কমিশনের আমলে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, চলছে নির্বাচন নির্বাচন খেলা। এই খেলা বন্ধ করতে হলে তাদের অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। এই ইসি মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের রক্ত, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই তাদের অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে অনিয়ম করছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অতীতে অনেক কমিশন নানা কারণে বিতর্কিত হলেও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের ঘটনা এই প্রথম। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। বর্তমান কমিশন সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানকে অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যেদিন নির্বাচন হওয়ার কথা, সেদিন নির্বাচন হতে হবে; কিন্তু এই কমিশনের আমলে তা হয়নি। এই নির্বাচন কমিশনের আমলে যা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। নির্বাচন যেদিন হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে তার আগের দিন রাতে। এই কমিশন গুরুতরভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে।’
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই ইসি যা করেছে, তা গুরুতর অসদাচরণ। তারা আর্থিক অনিয়মও করেছে। রাষ্ট্রপতি এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদের অপসারণ করতে পারেন।’