সাগরে ফিশিং ট্রলারে রহস্যময় বিস্ফোরণ: ছয়জনের মৃত্যু

জুনায়েদ আহম্মেদ
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২১, ১৭:১৮

ছবি: বঙ্গোপসাগরে ফিশিং ট্রলারে বিস্ফোরণে ২১ জেলের মধ্যে নিহত- মিলন, মেহরাজ, রিপন মাঝি ও বেলাল
আটাশ বছর বয়সী বেলাল। ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরে সংসারের হাল ধরেন তিনি। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস মেঘনায় মাছ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে বেকায়দায় পড়েন তিনি। এসময় সরকারি নিবন্ধনহীন জেলেরা থাকেন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে।
পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে বেলালের মত অনেক জেলেই পাড়ি জমান বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে। পরিবারের খাবার যোগাতে রামগতি উপজেলার ২১ জেলে শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) মাছ ধরার ট্রলারে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে ছুটে যান।
কক্সবাজার থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রে পরদিন রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ওই ট্রলারে রহস্যময় এক বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। ট্রলারে থাকা ২১ জেলের মধ্যে মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ ১১ জনের মধ্যে বুধবার (১০ মার্চ) দুপুর পর্যন্ত মারা যান ছয়জন। এ ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফিশিং বোটের মালিক সোহেল ও মাঝি মনির নিহত ও আহত জেলে পরিবারের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। এদিকে ঘটনার নয়দিন পার হলেও ফিশিং ট্রলারে রহস্যময় বিস্ফোরণের ঘটনায় দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। আহত ও নিহতদের পরিবার এখনো পায়নি সরকারি কোনো সহায়তা।
এসব জেলেরা লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী, দক্ষিণ টুমচর ও চর রমিজ ইউনিয়নের চরগোসাই গ্রামের বাসিন্দা। বুধবার সকালে (১০ মার্চ) এসব জেলেদের বাড়িতে গিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। আহত ১০ জেলে সেদিনকার দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে উঠে। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় শুনসান অবস্থায় রয়েছে।
অগ্নিদগ্ধে মৃত ছয় জেলেরা হলেন- উপজেলার চর গাজী ইউনিয়নের দক্ষিণ টুমচর গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে বেলাল হোসেন (২৮), সিরাজুল হকের ছেলে মেহরাজ (২৬), চর লক্ষ্মী গ্রামের আবদুজ জাহেরের ছেলে মিলন (৩০), চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামের মন্তাজুল হকের ছেলে আবুল কাশেম মিস্ত্রী (৫৫), আবু তাহেরের ছেলে রিপন মাঝি (৩৮) ও দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মিরাজ (২৮)।
অগ্নিদগ্ধ অন্য পাঁচ জন জেলে হলেন- চর লক্ষ্মী গ্রামের খুরশিদ আলমের ছেলে আলাউদ্দিন, কামাল উদ্দিনের ছেলে সাহাবউদ্দিন, আবু তাহেরের ছেলে আবু জাহের, সিরাজুল হকের ছেলে মেহেরাজ উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিনের ছেলে মিরাজ উদ্দিন ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের শরীরের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই পুড়ে গেছে, জানালেন স্বজন ও চিকিৎসকরা।
ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী চর লক্ষ্মী গ্রামের জেলে শরীফ (২৫) জানালেন, মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নিষেধের কারণে পরিবারের অভাব মেটানোর জন্য কয়েকদিন আগে তারা একই গ্রামের মনির মাঝির মাধ্যমে স্থানীয় ২১ জেলে মিলে কক্সবাজারে যায়। সেখানে গিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় সোহেল কোম্পানির মালিকানাধীন এফবি ওশিন নামের একটি ট্রলারে গত শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে মাছ ধরতে সাগরে যান তারা। ট্রলার চালিয়ে কক্সবাজার থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে যান তারা।
পরদিন রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে সমুদ্রে জাল ফেলে কেবিনে ভাত খেতে যান ১১ জেলে। সাড়ে ৯টায় ওই ট্রলারে রহস্যময় বিস্ফোরণ ঘটে। পরপর তিনটি শব্দে ট্রলারের কেবিন উড়ে যায়। এতে কেবিনের ভিতরে থাকা ওই ১১ জন মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ হন। আর কেবিনের উপর থাকা কয়েকজন সাগরে পড়ে যায়। ট্রলারে থাকা একজন জেলে রশি ফেলে সাগরে পড়ে যাওয়া জেলেদের উদ্ধার করে। ঘটনার একঘণ্টা পর আরেকটি ফিশিং ট্রলার এসে ৩ ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে ২১ জেলেকে নেটওয়ার্ক এলাকায় নিয়ে আসে। এসময় জেলেরা তাদের ট্রলার এফবি ওশিনের মালিক সোহেল কোম্পানিকে ফোন করে বিষয়টি জানালে, কোম্পানি স্পিডবোট পাঠিয়ে তাদেরকেসহ ট্রলার কক্সবাজার নিয়ে আসে। আহতদেরকে প্রথমে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর থেকে আর খোঁজ নেয়নি কেউই।
জেলে শরীফ আরো জানান, প্রথমে ভেবেছিলাম ট্রলারের ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ হয়েছে, আমরা দেখলাম ইঞ্জিনের কিছুই হয়নি। গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো ঠিক ছিলো। ট্রলারও ঠিক ছিলো। কিভাবে আমরা এত লোক আহত হলাম? ওই বিকট শব্দটি কিসের ছিলো? আমরা জানি না।
শরীফ অভিযোগ করে জানান, আমাদেরকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর কোম্পানি ও মাঝি আজ পর্যন্ত আর তাদের কোনো খোঁজ নেয়নি।
এদিকে মারাত্মক আহত ও গরীব জেলেদের চিকিৎসা নিয়ে যখন সংকট দেখা দেয় সে খবর পেয়ে তাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসে রামগতি উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’। সংগঠনটি আহত ১১ জেলেকে গত মঙ্গলবার (২ মার্চ) ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করায়। পাশাপাশি রোগীদের সেবায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত করে, চিকিৎসা ও খরচের অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।
‘স্বপ্ন নিয়ে’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, মানবিক দিক থেকে বিপদে পড়া জেলেদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন জেলেদের অবস্থা বেশি ভালো না। তিনি গরিব, মারা যাওয়া ও চিকিৎসাধীন জেলে ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য লক্ষ্মীপুর জেলাবাসীসহ দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।
রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন জানান, অগ্নিদগ্ধ বেশিরভাগ জেলের বাড়িই তার এলাকায়। আর্থিক সঙ্কটের কারণে ওইসব জেলেদের পরিবার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরই মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে দুইজন জেলে, শনিবার একজন, সোমবার একজন, মঙ্গলবার একজন ও বুধবার একজন জেলে মারা যায়। চিকিৎসাধীন অন্য জেলেরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে জানালেন এ জনপ্রতিনিধি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন জানান, কি কারণে জেলেদের ট্রলারে বিস্ফোরণ হয়েছে তার খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। আহত ও মারা যাওয়া জেলেদের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রণীত জেলে সহায়তা নীতিমালা-২০১৯ অনুসারে তারা কোন আর্থিক সহায়তা পাবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, সেজন্য তাদেরকে নিবন্ধিত জেলে হতে হবে। তবুও তারা যেহেতু জেলে সেকারণে তিনি প্রস্তাবনা পাঠাবেন বলেও জানালেন।