-60629119c0e53.jpg)
নতুন করে করোনার প্রকোপ বেড়েছে, কিন্তু সচেতনতা বাড়ছে না। ছবি: স্টার মেইল
করোনাভাইরাসের ইউকে ভেরিয়েন্টের জন্যই কি বাংলাদেশে সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে? মার্চ শুরুর পর থেকেই সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ভাইরোলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মধ্যে এ প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে!
ইউকে ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব রয়েছে, তা আইইডিসিআর- এর পরিচালকও স্বীকার করেছেন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শীতে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এলেও, গরম বাড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গত বছরের ডিসেম্বরের পর গতকাল সোমবার (২৯ মার্চ) সারাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ১৮১ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৫ জন। এর আগের দিন মৃত্যু হয়েছিল ৩৫ জনের। সংক্রমণের হার আবারো বেড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮.৩৮ শতাংশ। দাঁড়িয়েছে। আর মোট পরীক্ষায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ০১ শতাংশ। ফলে আগের মতোই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। সরকারের নীতি নির্ধারকরাও এটি নিয়ে এখন বেশ চিন্তিত। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। মানুষকে মাস্ক পরানো ও হাত ধোয়ার অভ্যাসে ফিরিয়ে নিতে হবে। বন্ধ করে দিতে হবে পর্যটন স্পটগুলো। একইসাথে মানুষের চলাচল সীমিত করে দিতে পারলে ভাইরাস বেশি দূর ছড়াতে পারবে না।
নতুন ভেরিয়েন্টের জন্যই কি বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়ছে?
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, আইইডিসিআর ল্যাবে ১৫ জনের শরীরে ইউকে ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে ইউকে ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে, তাদের দ্রুততার সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউকে ভেরিয়েন্টটি ছড়িয়ে পড়লো কি-না এটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। যদি পার্সেন্টেজ বেশি থাকে, তবে বলতে পারব ছড়িয়ে পড়েছে।’
স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, আগে তরুণদের সংক্রমিত হওয়ার হার কম হলেও, বর্তমানে নতুন ভেরিয়েন্টে শিশু ও তরুণরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে কম বয়সী রোগীদের বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এখনকার ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে যাদের বয়স বেশি এবং জটিল রোগ রয়েছে তারাই বেশি সমস্যায় পড়তে পারেন।
চিকিৎসকরা জানান, অনেকের মধ্যে করোনার লক্ষণ থাকলেও আরটি-পিসিআর টেস্টে তারা কভিড-১৯ নেগেটিভ থেকে যাচ্ছেন। এটি একটি নতুন সমস্যা। নতুন ইউকে ভেরিয়েন্টকে ডিটেক্ট করার ক্ষমতা আরটি পিসিআর টেস্টের কম; কিন্তু ডায়াগনোসিস না হলেও চিকিৎসকদের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখে রোগীকে করোনার চিকিৎসা দিয়ে যেতে হবে। ডায়াগনোসিস করার জন্য এক্সরে ও রক্ত পরীক্ষাও করাতে হবে।
‘নতুন ভেরিয়েন্ট আরটি-পিসিআর মেশিনে ধরা নাও পড়তে পারে। এজন্য সিটি স্ক্যান, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, লক্ষণ-উপসর্গ দেখে চিকিৎসা নিতে হবে। শুধু যে পিসিআর টেস্টে ধরা পড়বে না এমন নয়, আফ্রিকার ভেরিয়েন্টটি নাকের সোয়াবে (নাকের ভেতরে থাকা আঠালো শ্লেষ্মা) ধরা পড়ছে না এমন ঘটনার কথা বলছেন, আমেরিকান বিজ্ঞানীরা।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইউকে ভেরিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এখন দরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকুয়েন্স করা। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি কতটুকু ছড়িয়েছে। এতে সরকারের করণীয় নির্ধারণ করা সহজ হবে।’
ইউকে ভেরিয়েন্টটি খুবই সংক্রামক
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে ইউকে ভেরিয়েন্টটি ছড়িয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট। আফ্রিকার ভেরিয়েন্টটিও ২০টির চেয়ে বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রূপান্তরিত এই ভাইরাসগুলো খুবই সংক্রামক এটি সব ভাইরোলজিস্টরা বলেন; কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, ভাইরাসটি খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। ভাইরাসগুলো টিকে থাকার জন্য নিজের মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে যাচ্ছে। আবার এর মধ্যেই সামান্য কিছু ভাইরাস রয়েছে, যেগুলো মারাত্মক ও বিপজ্জনক। তবে সাধারণভাবে এদের ছড়ানোর ক্ষমতা বেশি। ফলে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, ‘এই ভেরিয়েন্টগুলোতে আক্রান্ত হলে কেউ সিরিয়াস অসুস্থ হচ্ছেন। তবে যাদের বয়স একটু বেশি (৮০’র বেশি) ও যাদের অন্যান্য মারাত্মক রোগ রয়েছে, এ ভাইরাসটি আক্রান্ত করলে তাদের জন্য একটু ঝুঁকি রয়েছে।’
তবে কেউ কেউ বলছেন, ইউকে ভেরিয়েন্টে উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ শতাংশ উচ্চ ঝুঁকিপুর্ণ। তবে এটি প্রমাণে হার্ড এভিডেন্স নেই বলেছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম; কিন্তু অন্যদের থেকে দূরত্ব রেখে চললে, ঘন ঘন সাবান অথবা জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধুলে ও মুখে মাস্ক পরে থাকলে শুধু ইউকে ভেরিয়েন্ট কেন অন্যান্য ভাইরাস থেকেও প্রতিরোধ করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে রূপান্তর করে নিজেদের টিকিয়ে রাখে ও মানুষের কোষে ঢুকে যেতে চেষ্টা করে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকলে তখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইউকে ভেরিয়েন্টটি অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক।
ইউকের এই ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কি বাংলাদশে ব্যবহার করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কাজ করবে । এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে। কারণ সবগুলো টিকাই শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের প্রথম দিককার গঠনের বিষয়টিকে সামনে রেখে। তখন পর্যন্ত এই ভাইরাসটি তেমন কোনো রূপান্তর ঘটায়নি নিজের মধ্যে। তবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন টিম দাবি করেছে, ইউকে ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধেও তাদের উদ্ভাবিত টিকা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছে। তবে তারা বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে তাদের ভ্যাকসিন কম কাজ করছে; কিন্তু তাদের ভ্যাকসিন নেয়া হলে আফ্রিকান ভেরিয়েন্টও আক্রান্ত করলে খুব বেশি অসুস্থ করে না এমন প্রমাণ রয়েছে।
শীতের ভাইরাসগুলো গরমে নেই বলেই করোনা বাড়ছে!
শীতে বাংলাদেশে কয়েক ধরনের ভাইরাস সক্রিয় হয়ে থাকে ও এ ভাইরাসগুলো দিয়ে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ সংক্রমিত হয়ে থাকে। কারও মধ্যে মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়, কারও একটু উপসর্গ বেশি ও কারও মধ্যে এই ভাইরাসের কোনো উপসর্গই দেখা দেয় না। এই ভাইরাসগুলোর সাথে মানুষ বেশ পরিচিত। এই ভাইরাসগুলোর সংক্রমণে মানুষের জ্বর, সর্দি ও কাশি হয়ে থাকে ও এগুলোর সাথে শরীরও মানিয়ে নিয়েছে। এজন্য বেশির ভাগ মানুষকে ওষুধ খেতে হয় না, হাসপাতালে যেতেও হয় না। মৌসুমি ফল, লেবু, কমলা, আনারস, টক খেয়ে অনেকেই সুস্থ হয়ে যান।
অধ্যাপক ডা. নজরুল বলেন, ‘একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে আমি মনে করছি, গরমে করোনা বৃদ্ধি পাওয়ার এটিই বড় কারণ। তবে আমার এই কথাগুলো কেবলই অনুমান। এটি প্রমাণ করার জন্য গবেষণা করতে হবে। এজন্য সরকারকে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে ও কয়েকজন গবেষককে গবেষণার জন্য এ কাজে লাগাতে হবে।’