সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্ব নেতাদের মুখে বাংলাদেশের প্রশংসা

মাসুদুর রহমান
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১০:০০

নরেন্দ্র মোদি, মোহাম্মেদ সলিহ, মাহিন্দ রাজাপাকসে, বিদ্যা দেবী ভান্ডারী ও লোটে শেরিং
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পৃথিবী এখন ভয়াবহ এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। কোনো দেশের নেতাই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
এ সময়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে যেহেতু বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর তালেবানের সাথে যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তান নিজেরাই নানা সংকটে। তাই আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি।
অবশিষ্ট পাঁচটি দেশ মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও ভারতের শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশের উৎসবে যোগ দিয়েছেন। যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান হয়েছে; তবুও বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন। তারা সবাই কভিড-১৯ মহামারির এক বছরে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশ সফরে বের হলেন। এমনকি ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং উৎসবে যোগদানের কারণে দেশে ফিরে গিয়ে ২১ দিনের কোয়ারেন্টিনে আছেন। এতটাই ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের মূল পরিকল্পনা মোতাবেক, ২০২০ সালে বছরব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করার কথা ছিল। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া হয়; কিন্তু মহামারির কারণে তা শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। ওই সময়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করবেন বলে কর্মসূচি ঠিক হয়েছিল; কিন্তু অনুষ্ঠান না হওয়ায় তার সফর বাতিল হয়। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনেও বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু মহামারির কাল দীর্ঘ হওয়ায় দুটি উপলক্ষকে একত্রে করে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনে মহামারির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের নেতাদের বাংলাদেশে আগমন বিরল ঘটনা। তাদের সফর বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অগাধ আস্থার প্রতিফলন।
দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তারা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা দুনিয়ার মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেরণার উৎস। তিনি যেভাবে একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন, তা সত্যি বিরল। জাদুকরী গুণ ছিল তার। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হওয়া জাতি বিগত ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের তারপর উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা এদেশের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
মহামারির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের নেতারা বাংলাদেশের উদযাপনে আসতে না পারলেও বার্তা পাঠিয়েছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তারা পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল; কিন্তু ওই সময়ে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্নায়ুযুদ্ধের আরেক নেতা ওই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভকে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য রাজি করিয়েছিলেন। ওই কারণে সপ্তম নৌবহর ভিড়তে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার এসব বিষয়ে বেশি জোর দেয়- বিধায় তারা শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে পরিচালিত নির্বাচন নিয়ে খুশি নয়। তাই সরকারের অনুমান ছিল বাইডেন প্রশাসনের কোনো নিচের পর্যায় থেকে বার্তা আসতে পারে। বাস্তবে দেখা গেল, বাইডেন নিজে বার্তা পাঠালেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী দেশগুলো বার্তা পাঠাতে কোনো দ্বিধা করলো না।
যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত মেরুর দেশগুলোও বার্তা দিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথম দিনেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ও বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ অনেক নেতা অভিনন্দন জানিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিনন্দন জানিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন তাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে তার পিতার অবদান উল্লেখ করেন। তার পিতা পিয়ারে ট্রুডো বাংলাদেশের শরনার্থীদের সহায়তা করেছিলেন। ওই সময়ে কানাডা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ভুক্ত দেশ; কিন্তু মানবিক কারণে তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তা করেন। পিয়ারে ট্রুডো জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠক করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরে এলে তার পিতার সাথে আজকের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও বাংলাদেশ সফর করেন।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সলিহ, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করায় তাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃথক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয় উঠে এসেছে। ফলে সব বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা করে করণীয় নির্দেশনা পাওয়া গেছে। ফলে এসব সফর নিছক উদযাপনের সফরই ছিল না। বরং সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার রূপরেখাও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছে। অবশ্যই সম্পদেও সুষমবন্টন একটা বড় ইস্যু। বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে যা অর্জন করছে সেটিকে মিরাকল বলা হলেও অর্জিত সম্পদ সব জনগোষ্ঠী সুষমভাবে পাচ্ছে কি-না সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। লুটেরাদের হাতে সম্পদ চলে গেলে বিশাল অর্জনের কোনো সুফল বাংলাদেশ পাবে না। পাশাপাশি বাংলাদেশকে সুনামের রেকর্ডও রাখতে হবে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে বাংলাদেশের রেকর্ড এখনো ভাল নয়। শুধু অর্থনৈতিক তথা অবকাঠামোর উন্নতি টিকসই অগ্রগতির মানদন্ড নয়। এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতির লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।