-608e34469be67.jpg)
ঋণ আর ক্ষুধার আতঙ্কে দরিদ্ররা। ছবি : স্টার মেইল
করোনাভাইরাস আতঙ্কে প্রায় ঘরবন্দি হয়ে আছেন দেশের অধিকাংশ মানুষ। খেটে খাওয়া দিন মজুররা ঠিকমতো কাজে যেতে পারছেন না। গণপরিবহন বন্ধ। আর এ সেক্টরে কাজ করার মানুষগুলো চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
তাদের অনেকেই বিভিন্ন সমিতি থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা করার জন্য ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের বোঝা নিয়ে দিন শুরু হচ্ছে অনেকের এবং সেইসঙ্গে আছে ক্ষুধার জ্বালা। প্রতিটি দিন কাটছে তাদের আতঙ্কের মধ্যে। অনেকেই সরকারি সাহায্যের দিকে চেয়ে আছেন। সমাজ বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানীর মুগদার বাসিন্দা জসিম মিয়া মিডওয়ে বাসের হেলপার। গত ১২ বছর ধরে তিনি এই শহরে আছেন। এতো খারাপ সময় এর আগে কখনো আসেনি তার। এখন তিনি ভীতসন্ত্রস্ত সামনের দিনগুলো নিয়ে। তার ভয় নয় বছরের মেয়ে আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে অনাহারে থাকার। গত বছর শুধু বেঁচে থাকার জন্য ২৫ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে ছিল যে, ভাত আর শুকনো মরিচ খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। এভাবে খাওয়ার কারণে তার পেটের অসুখ হয়েছে। তিনি সেই ধারের টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যদি লকডাউন আবার দীর্ঘস্থায়ী হয়, বাস যদি না চলে আমরা কি কাজ করব? খাবো কি? ঘরভাড়া দিবো কি? কিস্তির টাকা পরিশোধ করবো কীভাবে? মাথায় কিছু আসছে না। দিন শুরু হয় হতাশা দিয়ে, আর শেষও হয় হতাশা নিয়ে।
আঁখি বেগম ওয়ারিতে দুটি বাসার গৃহকর্মীর কাজ করেন। গত বছরের শেষের দিকে মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল হলে তিনি কাজ পান। এখন আবারো শুরু হওয়া লকডাউনে তিনি কাজ হারানোর ভয়ে আছেন। অনাথ ভাগ্নে ও ভাগ্নি তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এক বাসায় সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করতাম। এ সপ্তাহে তারা আমাকে বলেছেন, সপ্তাহে দু’দিন করে আসতে। আমার মনে হয় কাজটি আর বেশি দিন থাকবে না।
মুগদার জসিম মিয়া কিংবা ওয়ারির আঁখি বেগমের মতোই করোনাভাইরাস আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে বসে আছেন নিম্নআয়ের অধিকাংশ মানুষ। খেটে খাওয়া দিনমজুর কাজে যেতে পারছেন না। আয় রোজগার বন্ধে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে তাদের। কাজ হারানোর ভয় রয়েছে। আবার তাদের তাড়া করে ফিরছে এনজিওর কিস্তি। ক্ষুদ্রঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব মানুষরা।
কাকডাকা ভোরে এনজিওর কিস্তি আদায়কারী কর্মকর্তা বেরিয়ে পড়ছেন। ঘরের কড়া নাড়ছেন কিস্তির টাকার জন্য। টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে আর রক্ষা নেই। যেভাবেই হোক কিস্তির টাকা তাদের চাই। কথাগুলো বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাভলী শামসুন্নাহার।
তিনি বলেন, এখন নিম্নআয়ের মানুষদের রোজগার নেই। দিনমজুররা অনেকেই কাজ করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করত। এখন ঋণের কিস্তি পরিশোধের চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ছে সাধারণ মানুষের। কারণ কাজ বন্ধ হলেও ঋণের টাকা পরিশোধ সাময়িকের জন্য বন্ধ হয়নি। তারা ঠিকই কিস্তির টাকার জন্য ঘরে এসে কড়া নাড়তে থাকেন। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নিম্নআয়ের মানুষদের বাঁচাতে হবে। তা না হলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে সমাজে।
নারায়ণগঞ্জের রূপসা বাসস্ট্যান্ডে থাকেন শায়লা চৌধুরী। তিনি সাজেদা ফাউন্ডেশান থেকে লোন নিয়ে একটি দর্জির দোকান করেছেন। প্রতি মাসে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। তিনি জানান, করোনার কারণে আগের মতো আর কাস্টমার নেই। তাই হাতে টাকাও নেই। খুব অভাবে আছি।
পুরান ঢাকার ধুপখোলায় সিএনজি গ্যারেজ মালিক আবুল কাশেম হতাশার স্বরে বলেন, আমি কিস্তির টাকা নিয়ে সিএনজি কিনে ভাড়া দিয়েছি। এত দিন ভালোই চলছিল। প্রতিদিন ভাড়ার টাকা আসে আর সেখান থেকে কিস্তির ঋণের টাকা পরিশোধ করতাম; কিন্তু লকডাউনের কারণে এখন আগের মতো সিএনজি থেকে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যে কয়েকটি ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি, তা এখন পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন মুদি দোকানদার জানান, আমাদের নিজেদের টাকার পরিমাণ খুবই কম। চালান না থাকায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে দোকান করি। ঘরে থাকতে হলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হবে। তখন ঋণের কিস্তি শোধ করবো কীভাবে? তাই অনেকে মাথায় হাত দিয়ে দিয়েছে। একদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্ক আবার অন্য দিকে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধের চিন্তা। কোন দিকে যাবো আমরা সাধারণ জনগণ।
এছাড়াও কয়েকজন নিম্নআয়ের মানুষ বলেন, আমাদের তো কাজ করলে পেটে ভাত জোটে, না করলে জোটে না। আমরা কীভাবে ঘরে থাকব? এর ওপর কমবেশি কিস্তি আছে সবার। সরকারের কাছে অনুরোধ করোনাভাইরাস সংক্রমণ যতদিন না যায় ততদিন অন্তত আমাদের কিস্তিটা বন্ধ রাখুক। নতুবা একদিকে করোনার আতঙ্ক তার ওপর কিস্তির চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনজিও কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ অফিস যে আদেশ দেন, আমরা সেই মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য। তবে বর্তমান যে অবস্থা তাতে কিছু দিন ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখা উচিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ ঠিকমতো কাজে বের হতে পারলে আর কোনো সমস্যা হবে না।
৪১ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান গুলিস্তান মোড়ে কাপড় বিক্রি করেন। পহেলা বৈশাখ আর ঈদের কথা মাথায় রেখে তিনি এক লাখ টাকা ধার করে কাপড় কিনেছিলেন। তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখের আগে লকডাউনের কারণে বিক্রি করতে পারলাম না। এখন যদি ঈদের আগেও এমন থাকে, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। কী করব? কীভাবে ধারের টাকা পরিশোধ করব। কোনো কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত পুরো লকডাউনের সময়টা টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা।
এ পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, সরকারের কাছে প্রত্যাশা করছি, যাতে এসব মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদেরকে প্রণোদনার ব্যবস্থা শিগগির করা হয়।