রেশন দিয়ে সংসার চলে না
মহালছড়িতে জেলেদের মানবেতর জীবনযাপন

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২ মে ২০২১, ১৫:৪৩

সুজন আলীর বয়স ৬০ পেরিয়েছে। ছাব্বিশ বছর ধরে কাপ্তাই লেকে মাছ ধরে তার সংসার চলে। বর্তমানে পরিবারের সদস্য ৮ জন। ১ মে থেকে তার কোনো কাজ নেই। প্রজনন মৌসুম হওয়ায় কাপ্তাই লেকে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ। আগামী ৯০ দিন কার্যত বেকার তিনি। চেঙ্গীর তীরে বসে কীভাবে সামনের দিনগুলো কাটাবে সেই শঙ্কার কথা এই প্রতিবেদককে জানান তিনি।
তার অভিযোগ, ‘আমার স্ত্রী ছেলে সন্তান নিয়ে পরিবারের লোক সংখ্যা ৮ জন। সরকার আমারদেরকে মাসে ২০ কেজি করে রেশনের চাল দিচ্ছে। এটা দিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ দিন চলবে। চালের সাথে অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী যোগাড় করতে হয়। মাছ ধরা বন্ধ আয় নেই।’ খাগড়াছড়ির মহালছড়ির ১৫৯১ জেলের জীবন প্রায় একই রকম।
সরেজমিনে মহালছড়ির মৎস্য উপকেন্দ্রের পাশে লাগালো সিলেটি পাড়ায় (জেলে পল্লী) ঘুরে সুজন আলীর কথার সত্যতা পাওয়া গেলো। ঈদ আসন্ন হলেও সে আনন্দ নেই জেলে পল্লীতে। দিনের খাবার জোগাতে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। মাছ ধরা বন্ধ। প্রতিটি পরিবারের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো পল্লীর মানুষের মাঝে দারিদ্রতার ছাপ। লেকে জাল পড়লেই তাদের সংসার চলে।
জেলে পল্লীর বাসিন্দা ফরিদা বেগম ও ফজর আলী জানান, ‘নয় মাস কাপ্তাই লেকে মাছ ধরে সংসার চলে। তিন মাস বন্ধ থাকে। এসময় আমাদের ফ্যামিলিটা পুরো অচল। এখন ২০ কেজি করে চাল দেয় সরকার। আমার ফ্যামিলিতে সদস্য আছে ৮ জন। সরকারি রেশন দিয়ে তো কিছুই হয় না। এসময় যদি সরকার একটু বাড়তি সহযোগিতা করতো তাহলে কোনো রকমে চলতে পারতাম।’
জেলে ফুলচান মিয়া জানান, ‘এবার (চলতি মৌসুমে) লেকে পানি কম ছিলো। মাছও কম পেয়েছি। এ জন্য কষ্ট বেড়েছে। উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি যে সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে তা অত্যন্ত কম।’
কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, কাপ্তাই লেকে মাছ ধরে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলার প্রায় ৪ হাজার জেলে পরিবারের সংসার চলে। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রজনন মৌসুম হওয়ায় কাপ্তাই লেকে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এসময় জেলেরা বেকার হয়ে পড়ে। কর্মহীন দুঃস্থ জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে সরকার। পরিবার প্রতি দেয়া হয় ২০ কেজি চাল।’
তবে সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছে মহালছড়ি মৎস্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন মাছ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নেতারা। সমিতির সভাপতি ফরিদ মিয়া জানান, ‘জেলেরা সারা বছর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে মে থেকে জুলাই তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে এই সময়টাতে জেলেরা খুব কষ্টে থাকে। কারণ তাদের একমাত্র আয়ের উৎস মাছ ধরা। তাই মাছ ধরা বন্ধকালীন সময়টা তাদের যদি ভিজিএফ এর আওতায় রেশন দেয়া হয়। তবে ২০ কেজি চালের পাশাপাশি আর্থিক অনুদান বা অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী দিলে কোন রকমে বেঁচে থাকতে পারতো।’
মহালছড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রবীণ চন্দ্র চাকমা জানান, ‘চলতি অর্থবছরে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও দীঘিনালা ২৭৭৬ জন্য জেলের জন্য সরকার চাল বরাদ্দ দিয়েছে। মে ও জুন মাসে মহালছড়ির জন্য ৬৩ টন ও দীঘিনালার জন্য ৪৭ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি জেলে পরিবার ২০ কেজি করে চাল পাবে।’
জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল অপ্রতুল স্বীকার করেছ স্থানীয় মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন। বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছে সংস্থাটির কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘জেলে পরিবার প্রতি মাসিক ২০ কেজি চালের বরাদ্দ অপ্রতুল মনে করা হচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে জেলে মাথাপিছু বিশ কেজি চালের পরিবর্তে ৩০ কেজি বরাদ্দ করা যেতে পারে।’
কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের উপকেন্দ্র প্রধান মো. নাসরুল্লাহ জানান, ‘জেলার মহালছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলায় ২ হাজার ৭৭৬ জন নিবন্ধিত জেলে আছে। তারা মাছ ধরার বন্ধকালীন সময়টাতে ২০ কেজি করে রেশন পান। এটা আমাদের কাছে অপ্রতুল মনে হয়েছে। জেলেদের বরাদ্দ বাড়িয়ে ২০ কেজির পরিবর্তে ৩০ কেজি চাল বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, ২০২০-২১ অর্থ বছরে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপকেন্দ্রে মৎস্য আহরণ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ ৬০ হাজার ২৫৪ হাজার টাকা।’