সীমান্তবর্তী জেলায় ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ
অক্সিজেন সংকট, চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২১, ২৩:৫৪

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। ছবি: বিবিসি
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে এসব জেলায় লকডাউনের কথাও ভাবছে সরকার। এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং সাতক্ষীরাসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বৃদ্ধির মুখে পরীক্ষা কম হওয়া এবং চিকিৎসা ও অক্সিজেন সংকট নিয়ে চিকিৎসকদেরই অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেছেন, সংক্রমণ ঠেকানোর ব্যাপারে এখনই জোর দেয়া না হলে হাসপাতালগুলো চাপ সামলাতে পারবে না।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধিতে এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি রয়েছে উত্তর পশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এই জেলায় স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ লকডাউনের সময় আরো সাত দিন বাড়িয়ে দিয়েছে।
যদিও সেখানকার প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথম দফার সাতদিনের বিশেষ লকডাউনের কারণে জেলাটিতে সংক্রমণের হার ৬০ শতাংশ থেকে কমে চল্লিশ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; কিন্তু চিকিৎসকদের অনেকে বলেছেন, রোগী শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার সভাপতি এবং সেখানকার বিএমএ'র সাধারণ সম্পাদক ডা. গোলাম রাব্বানী বলেছেন, তাদের জেলায় অক্সিজেন সংকট এবং হাসপাতালে আসনের তুলনায় রোগী অনেক বেশি হওয়ায় ইতিমধ্যেই চিকিৎসাসেবা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেছেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেক রোগী আসছেন। যেগুলোর ডায়াগনসিস বা টেস্ট হচ্ছে না। এছাড়া অক্সিজেন স্যাচ্যুরেশন কম-এমন অনেক রোগীও আসছে।
তিনি আরো বলেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোন আইসিইউ নাই। এখানে আধুনিক হাসপাতালে অক্সিজেনের যে ব্যবস্থা আছে, তাতে পনেরো জনকে সেবা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানে অক্সিজেন প্রয়োজন, এমন বিশ জন রোগী ভর্তি আছে। যারা এখানে বেডের অভাবে ভর্তি হতে পারছেন না, তাদের অনেকে রাজশাহী যাচ্ছেন। বাকিরা কোথায় যাচ্ছেন বা কীভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন-তা আমাদের জানা নাই। কারণ কোন রেকর্ড নাই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশের জেলাগুলো যেমন রাজশাহী, নওগাঁ এবং নাটোরেও সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির মুখে এই জেলাগুলোতে আরটিপিসিআর টেস্টের পাশাপাশি অ্যান্টিজেন টেস্টও করা হচ্ছে। তবে আশে পাশের সব জেলা থেকে নমুনা নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরপিটিসিআর টেস্ট করা হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে ভাইরোলজি বিভাগে এই টেস্ট করা হচ্ছে, সেই বিভাগের অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার বলেছেন, বিশেষ লকডাউন থাকলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন এবং সে কারণে আশেপাশের জেলাতে সংক্রমণ বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীতেই সংক্রমণের হার বেশি। এরপর নওগাঁ এবং নাটোরে সংক্রমণ বাড়ছে। দ্রুত এই সংক্রমণ বেড়ে গেলো। লকডাউন দেয়ার পর সবাই মনে করছে যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোক সেখানেই আছে। কিন্তু আসলে যে কোনভাবেই হোক চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক লোক জীবিকার তাগিদে রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় গেছে। সেজন্য সীমান্তবর্তী জেলা না হলেও রাজশাহীতে সংক্রমণ বেড়েছে। তাদের যাতায়াতের কারণে সংক্রমণ যে ছড়াবে- এই জিনিসটা সবচেয়ে ভয়ংকর।
ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে সাতক্ষীরাতেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে বলা হচ্ছে। সোমবার জেলাটির স্থানীয় প্রশাসনের এক বৈঠকে সীমান্তবর্তী ইউনিয়নগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সাতদিনের লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন ডা. হোসাইন শাফায়াত বলেছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে সেখানেও চিকিৎসার চাপ সামলানোর সামর্থ্য নেই। সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে এখন এটা চল্লিশ শতাংশের উপরে চলে গেছে। আসলে এটা বেশ উদ্বেগজনক অবস্থা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে অনেক রোগী ভর্তি হয়েছে। এবং সিটি সংকট চলছে, বেড সংকট চলছে।
তিনি আরো বলেছেন, রোগী যেহেতু বেড়ে গিয়েছে, সেজন্য আমরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়নগুলো আগে লকডাউন করছি। পরে আরও তিন দিন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজন হলে পুরো জেলাকেই লকডাউন করবে জেলা প্রশাসন।
তবে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জেলাগুলোতে টেস্ট কম হওয়া বা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকটের কথা মানতে রাজি নন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।অন্যদিকে নওগাঁ নাটোর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া এবং খুলনা- এই সাতটি জেলায় বিশেষ লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সরকারের পক্ষে মন্ত্রী পরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, জেলাগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এমন নির্দেশনা তাদের দেয়া হয়েছে।
কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো সংক্রমণ এবং মৃত্যু বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে কঠোর বিধিনিষেধ দিতে বিলম্ব হলে সংকট আরো বাড়বে।
এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বিশেষ লকডাউনের সময় সোমবার রাত থেকে আরও সাত দিন বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে মানুষের মদ্যে আতংক রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বিবিসিকে বলেছেন, ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি খুবই কম। এই জেলাগুলো যে হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার তুলনায় মাত্র ২৩ জনের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। কাজেই আমরা মনে করি না যে, এটা এখনই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা যদি ঐ জায়গাটা কনটেন করতে পারি তাহলে আমরা নিশ্চয়ই এটাকে প্রতিরোধ করতে পারবো।
স্বাস্থ্য বিভাগ এ মুহূর্তে সংক্রমণের লাগাম টানা বা প্রতিরোধের ব্যাপারে জোর দেয়ার কথা বলছে। তবে সংক্রমণ দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব কতটা হবে- তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে।
জুনে হচ্ছে না ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
দেশে এবার প্রথমবারের মতো ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৯ জুন মানবিক, ২৬ জুন বাণিজ্য ও ৩ জুলাই বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেবার পর ১০দিন পর্যন্ত আবেদন করা যাবে বলে সিদ্ধান্ত ছিল। তবে আগের এই পরিকল্পনা আপাতত কার্যকর হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ক টেকনিক্যাল সাব-কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, জুনে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার আমরা এই মুহূর্তে নতুন কোন তারিখ ঘোষণাও করতে পারছি না। কারণ, সরকার ঘোষিত ‘লকডাউন’ যদি আগামী ৭ই জুন থেকে তুলে নেয় তাহলে প্রাথমিক আবেদন শেষ হবে ১৬ জুন। এরপর আমাদের অনেক কর্মযজ্ঞ রয়েছে।
যেমন চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ ও আবেদন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ইত্যাদি। তাই ধরেই নিতে পারি আগামী ১৯ জুন থেকে পরীক্ষা হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু আমরা জানি না ‘লকডাউন’ আরো বাড়বে কীনা। তাই নতুন করে আপাতত তারিখ ঘোষণা করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা শিগগির এ ব্যাপারটি নিয়ে মিটিং ডেকে আলোচনা করবো। সেখানে ভর্তি পরীক্ষার পুনঃনির্ধারিত তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
ড. মুনাজ আহমেদ নূর আরো বলেন, যেহেতু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে সেহেতু এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না।
প্রসঙ্গত, এই ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন সর্বোচ্চ দেড় লাখ শিক্ষার্থী। আবেদন শুরু হয় গত ১লা এপ্রিল থেকে। প্রাথমিক আবেদন শেষে ছয় ক্রাইটেরিয়া ক্রমানুসারে ব্যবহার করে চূড়ান্ত মেধাক্রম প্রস্তুত করবে সমন্বিত ভর্তি কমিটি। তারপর মেধা তালিকা প্রকাশ করে চূড়ান্ত আবেদন করতে হবে শিক্ষার্থীদের।