Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২১, ১৯:৫৬

নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ব্যস্ত এক স্বাস্থ্যকর্মী

দেশে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, যাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হিসেব চিহ্নিত করছে, তা অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট বা আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছে যে পরীক্ষিত নমুনার মধ্যে চার পঞ্চমাংশই করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।

আইইডিসিআর জানায়, গত ১৬ মে পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে করোনাভাইরাসের ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে এবং ফলাফল হিসেবে নমুনার ৮০ শতাংশের মধ্যেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।

দেশের যেসব জায়গা থেকে নমুনা নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং খুলনা। এর মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গোপালগঞ্জ এবং খুলনায়।

আইইডিসিআর একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে সংগ্রহ করা ১৬টি নমুনার মধ্যে ১৫টিই ছিলো ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। 

এই গবেষণার ভিত্তিতে আইইডিসিআর বলেছে, দেশে কভিড ১৯-এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের (ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট) কমিউনিটি সংক্রমণ বিদ্যমান।

গোপালগঞ্জ জেলা থেকে সংগ্রহ করা সাতটি নমুনার মধ্যে সবগুলোই ছিল ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। খুলনা শহর থেকে তিনটি নমুনার মধ্যে সবগুলোই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এছাড়া ঢাকা শহরের চারটি নমুনার মধ্যে দুইটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, যাদের মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে আটজন ভারতে ভ্রমণ করেছে। এছাড়া ১৮ জনের বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। তবে ১৪ জনের দেশের বাইরে ভ্রমণ অথবা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এদিকে দেশে করোনা সংক্রমণ বেশ কিছুদিন কম থাকলেও গত এক সপ্তাহে তা ফের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ উত্তর ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে করোনায় সংক্রমণ, শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়ে গেছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশের ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

এর ফলে ওই অঞ্চলে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। অনেক হাসপাতালে শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। আবার অনেকে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। এছাড়া অনেক রোগী চাহিদা অনুযায়ী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবাও পাচ্ছেন না। 

এদিকে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দুটি জেলা সম্পূর্ণ ও সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সীমান্তসহ কয়েকটি জেলায় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সংক্রমণ আরো বেড়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন তারা।    

সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা করোনা সংক্রমণের নতুন হটস্পট হয়ে উঠছে। ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরায় পরিস্থিতি সামাল দিতে  শনিবার (৫ জুন) থেকে সাতদিনের বিশেষ লকডাউন শুরু হয়েছে।

বাগেরহাটের মংলায় গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের শতকরা হার ৪০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে, যা নিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিভাগীয় শহর খুলনায় সংক্রমণ পরিস্থিতিও নাজুক হয়ে পড়ছে।

শনিবার (৫ জুন) বাগেরহাটের সিভিল সার্জন কে. এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, পুরো বাগেরহাট জেলার পরিস্থিতি নাজুক না হলেও মংলা উপজেলায় সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। মংলা উপজেলায় সংক্রমণ ২৬ মে থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জেলায় এখন রোগী চিকিৎসাধীন আছে ২৬৪ জন। এর মধ্যে ১৬৪ জন মংলা উপজেলায়। শনাক্তের হার উঠানামা করছে। প্রথম তিনদিন ছিলো ৭০ পার্সেন্ট। গত দুইদিন ছিলো ৪০ পার্সেন্ট, আজকে আবার ৭০ পার্সেন্ট।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় পরীক্ষা অনুপাতে ৭০ শতাংশ করোনা শনাক্ত হওয়ায় ঘটনা অনেককেই চমকে দিয়েছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, জেলায় নমুনা পরীক্ষায় শতকরা ৪০ ভাগ এখনো পজিটিভ আসছে। আর হাসপাতালের বেড যত বাড়ানো হয় ততই ভরে যায়। প্রথমে করোনা রোগীদের জন্য ২০ বেড, তারপর ৩০ বেড ও এখন ৫০ বেড করা হয়েছে। তাও ভরে গেছে।

তিনি আরো জানান, পরিস্থিতি সামলাতে তারা তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন- লকডাউনেও মসজিদে লোক সমাগম কমানো যাচ্ছে না; আমের মৌসুম হওয়ায় আম ব্যবসায়ীরা লকডাউন মানছেন না ও সীমান্তে অবৈধ যাতায়াত বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ভারতীয় ধরনটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেশে বাড়তে থাকার মধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোয়ারেন্টিন ও জেলাভিত্তিক কঠোর লকডাউনের পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার একটু ধীরে হলেও সেটি বাড়ছে। তবে সংক্রমণের হার যে বাড়ছে, সেটি শুধু সীমান্ত এলাকাতেই না, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় হচ্ছে। কোনো কোনো জেলায় এখনো কম আছে, কিন্তু গড় হিসাব করলে দেখা যাবে সেটির হার ১০ এর উপরে।

এই সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। তবে বিএসএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, এখনো দ্বিতীয় ঢেউই তো শেষ হয়নি, চলছে৷ সংক্রমণ এখনো শতকরা ১১ ভাগের বেশি। পাঁচ ভাগের নিচে নামার পর আবার বাড়লে তাকে আমরা নতুন ঢেউ বলতে পারি। এখনো তো আবার মৃত্যু বাড়ছে।

তিনি মনে করেন, এখন বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে স্থানীয়ভাবে। তবে জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা আরো বাড়াতে হবে। না হলে পরিস্থিতি পুরোপুরি বোঝা যাবে না। আর করোনা তো করোনা, সেটা ভারতীয় হোক আর আফ্রিকান হোক। এটা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এখন সারাদেশে করোনা চিকিৎসা, বিশেষ করে অক্সিজেনের ওপর জোর দিতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে টিকা দিতে হবে।

ডা. মুশতাক হোসেন আরো বলেন, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলে সেটি আগের ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে দেয়। যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে দেশেই নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ বাড়ায় না, বরং সংক্রমণ বাড়লে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. নজরুল ইসলাম করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের দ্রুত বিস্তার প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের দেশে ২২টি জেলায় সংক্রমণের হার বেড়েছে। তার মধ্যে ১৫টিই সীমান্তবর্তী জেলা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই না, এবারের ঈদুল ফিতরে ঢাকা থেকেও যারা এসব জেলায় গিয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই ভাইরাস বহন করে নিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, সারাদেশে যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে তা বলার সময় এখনো আসেনি। যে নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করেছি তা সারাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে সীমান্ত এলাকা এবং ঢাকা ও আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা তাদেরই জিনোম সিকোয়েন্স করেছি যারা ২৫ মে ও পরবর্তী সময়ে ভারত থেকে এসেছেন বা ভারত থেকে আসা ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছেন। ৫০ জনের মধ্যে যে ৪০ জন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিত তাদের ১৪ জনের ভারত যাওয়া বা ভারত থেকে আসা লোকজনের সংস্পর্শে আসার তথ্য নেই।

এদিকে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে না বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রবিবার (৬ জুন) দুপুরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত ভার্চুয়াল বুলেটিনে  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহে আমাদের পজিটিভ রেট বেড়ে গেছে। যদিও ৯২ ভাগ মানুষ সুস্থ হয়ে যাচ্ছে, সে জন্য আমরা আনন্দিত। সংক্রমণের দিক থেকে আমরা সাত থেকে আট শতাংশ নিচে নেমে এসেছিলাম। সেটি ক্রমাগত বেড়ে গেছে। গত এক মাসের চিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমরা ওই পর্যায়ে নেই যেখানে বলতে পারি আমরা স্টেবল। আমাদের ট্রান্সমিশন আনস্টেবল হয়ে গেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যে চিত্র দেখতে পাই, এপ্রিলের ভয়াবহতা আমরা ট্যাকেল করতে পেরেছি। জুন মাস যখন শুরু হয়েছে, মাত্র ছয় দিন। এর মধ্যে আমরা আট হাজারের বেশি করোনায় আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত করেছি। এই মাসটি গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

রোবেদ আমিন বলেন, আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে যেসব হাসপাতালগুলো আছে, সেখানে সেবা দেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লো ফ্লো অক্সিজেন সাপ্লাই। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলার আগে আমার নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এটি হলো জীবন রক্ষাকারী। যারা মুমূর্ষু অবস্থায় চলে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই লো ফ্লো অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীতে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। যে কারণে একটি মেডিকেল টিম সেন্ট্রাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থান করছে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, জরুরি রোগী ছাড়া যেন কাউকে ভর্তি নেয়া না হয়। প্রয়োজনে পুরো হাসপাতাল করোনা সেবায় ব্যবহার করা হবে। প্রান্তিক অন্য এলাকায়গুলোতেও তা-ই বলা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫