Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মাদকের গডফাদাররা ধরা পড়ছে না কেন

Icon

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ১২:১৮

মাদকের গডফাদাররা ধরা পড়ছে না কেন

দেশে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইটা দৃশ্যত ইয়াবার বিরুদ্ধে। ফাইল ছবি

করোনা মহামারির মধ্যেও বন্ধ হয়নি মাদক পরিবহন ও বেচাকেনা। পণ্যবাহী গাড়ি, পিকআপ, ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ, উত্তর ও পূর্বাঞ্চল দিয়ে নানাভাবে ঢাকায় আসছে মাদকের চালান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময় মাদকের চালান আটক করা হয়েছে। কিন্তু সব চালানের তথ্য জানা যায় না।

গত কয়েক মাসে পুলিশ, র‌্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্যের বড় বড় চালান ধরে। কাঁচামালের আড়ালে, ভ্যানের পাটাতনে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের ইঞ্জিনের ভেতরেও লাখ লাখ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে।

চোরাকারবারিরা অভিনব সব কায়দায় রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক। প্রাইভেটকারের মোবিলের চেম্বারে প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুরে রাখা হচ্ছে ইয়াবা। লোহার পাইপ, জুতা বা স্যান্ডেলের তলায় ও তৈজসপত্রের ভেতরেও ইয়াবা রেখে পাচার করা হচ্ছে। সাইলেন্সার কেটে গুঁজে রাখা হচ্ছে গাঁজার প্যাকেট। কাভার্ড ভ্যানের ভেতর আলাদা চেম্বারও বানিয়েছে অনেকে। যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় চালকের সামনে থাকা বিশেষ সুইচের মাধ্যমে। তল্লাশি এড়াতে এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে নারীরাও। 

গত ৪ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার বসিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা পাচারকারী চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করে র‍্যাব। তারা বেদের বেশে বহন করতো ইয়াবা। তারা বেদের মতোই জীবন-যাপন করতো ও সাধারণ মানুষের সন্দেহ দূর করতে পথের মাঝে বিভিন্ন মনিহারী দ্রব্য যেমন-চুড়ি, কড়ি, চুল বাধার ফিতা, শিশুদের কোমড়ে বাধার ঘণ্টা, চেইন, সেফটিপিন, বাতের ব্যথার রাবার রিং বিক্রি করতো। আর মাদক পরিবহনের জন্য টিনের তৈরি সহজে বহনযোগ্য রান্না করার চুলার মধ্যে বিশেষ কায়দায় ইয়াবা লুকিয়ে তা আবার ঝালাই করে জোড়া লাগিয়ে দিতো।  

প্রাচীনকালে কবুতরের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান করা হত। প্রেরিত চিঠি একটি চোঙার মধ্যে রেখে সেটি কবুতরের পুচ্ছের ওপরে মাঝখানের পালকে বেঁধে রাখা হত। সেই পন্থায় কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাঠাচ্ছে পাচারকারীরা। কবুতরকে যেখান থেকেই ছেড়ে দেয়া হোক, কবুতর নিজের বাসস্থানে ফিরে যাবেই। এ তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে কবুতরের পুচ্ছের ওপরে মাঝখানের পালকে ইয়াবার প্যাকেট বেঁধে কক্সবাজার থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়। আর তিন থেকে চারদিনের মধ্যে ঢাকার নির্ধারিত এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে সেই কবুতর। চার থেকে পাঁচশ’ ইয়াবা বয়ে নিতে পারে একেকটি কবুতর। শুধু কক্সবাজারই নয়; ঢাকার এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ইয়াবা পাঠাতে কবুতরকেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

গত ১৮ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবাসহ মাদক কারবারি চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। বিশেষ কায়দায় ছোট পলিথিনের পুঁটলি তৈরি করে মুখ দিয়ে গিলে পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করছিল ওই দুজন।

মাদকপাচার বন্ধে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় ২০১৮ সালে। ওই অভিযানে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৭২ জন। এতে দুই নারীসহ ১০৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিকও রয়েছেন। শুধু টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ১৬২ জন। অভিযানের আড়াই বছরের বেশি সময় পর এসে সরকারি সংস্থাগুলোই বলছে, দেশে মাদকের সরবরাহ ও মজুত কমেনি, বরং বেড়েছে।  

প্রশ্ন হল, মাদক ব্যবসা বন্ধ হল না কেন? এর উত্তরে অনেকেই বলছেন, মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে। আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহারও বন্ধ করা যাবে না। সরবরাহ বন্ধের দায়িত্ব সরকারের৷ সরকার তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না।  

নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ। 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমদাদুল হক এক গবেষণায় বলেছেন, ‘দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। এছাড়া আছে ফেন্সিডিল, হেরোইন ও অন্যান্য মাদক। এতদিন এ বিষয়টা খোলামেলাভাবে আলোচিত হয়নি, কিন্তু পরিস্থিতি সত্যি ভয়াবহ।’

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুরের লাশ দীর্ঘ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়েছিল। লাশ উদ্ধারের পর বন্ধুরা হত্যা ভেবে প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনও করেছিলেন। পরে জানা গেছে, ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে হাফিজ নিজেই নিজের গলায় কোপ দিয়েছিলেন। ভয়ংকর ড্রাগ সেবনে ও বিক্রিতে জড়িত বন্ধুরা তাকে এলএসডি সেবন করিয়েছেন। সেই সূত্রে ডিবি পুলিশ এলএসডি বাণিজ্য চক্রের সন্ধানে নেমেছে। সাফল্যও মিলছে। ধারণাতীত পরিমাণ এলএসডিও উদ্ধার হয়েছে।

দেশে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইটা দৃশ্যত ইয়াবার বিরুদ্ধে। ইয়াবার একটি বড় অংশ আসছে মিয়ানমার থেকে। কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে ঢুকে নানা কৌশলে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। গত বছরের জুলাইয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার পর ওই সড়কে একদিকে যেমন কড়াকড়ি, নজরদারি বেড়েছিল, তেমনি কমেছিল দেশে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। তবে ওই ঘটনা চাপা পড়তেই ইয়াবা আসা ফের বৃদ্ধি পেয়েছে।  ইয়াবা পাচারের পথ পরিবর্তন হয়েছে, ইয়াবার রঙও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রচলিত গোলাপি বা লালচে রঙের বদলে, হলুদ, বাসন্তী, হালকা গোলাপি ও সাদা রঙের ইয়াবা বড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে।  

মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার বেশ বড়৷ একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, মাদক ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি৷ সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন। তাদের মধ্যে- সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই আছে। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার৷ কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করে।

প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মাদকদ্রব্যসহ ধরা পড়ে মাদক ব্যবসায়ীরা। নিয়মমাফিক তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। গত ১২ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এক বছরে মাদক মামলায় সর্বনিম্ন আসামি হয়েছেন ৩৪ হাজার ৩১৫ জন, আর সর্বোচ্চ আসামি হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। কিন্তু এরপরও মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়নি। কারণ, যারা ধরা পড়ছে তারা মূলত বহনকারী। মূল ব্যবসায়ীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে৷ তাদের একাংশ মাদক চোরাচালান করেই এখন সিআইপি ব্যবসায়ী হয়েছেন। কিন্তু তারা ধরা পড়ছেন না, বা তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। সরকারের তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে। এতে বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাইয়ের নামও উঠে আসে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কখনই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তার তৎপরতা ছাড়াও আইনের ফাঁক ফোঁকর কাজ করছে বলেও অভিযোগ আছে।    

বাংলাদেশে প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও কারোর দখলে বা অবস্থানে মাদক পাওয়া না গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা গডফাদার তারা মাদক পরিবহণ বা নিজেদের কাছে রাখেন না। ফলে তারা মূল অপরাধী হলেও পার পেয়ে যান।

যারা খুচরা বিক্রয় করেন বা সেবন করেন শুধু তারাই ধরা পড়েন। আর আইনে মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা, পাচারকারী ও নিয়ন্ত্রক আলাদাভাবে নেই। ফলে যার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, তাকেই মামলায় আসামি করা হয়। আর আইনের এই দুর্বলতার কারণে মাদক মামলায় শাস্তিও হয় খুব কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের আগ্রাসন থেকে দেশ, সমাজ ও তারুণ্যকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কমিটমেন্ট থাকতে হবে। মাদক গডফাদারদের আত্মসমর্পণ নয়, তাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। মাদকের ব্যবহার ও পাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধের বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সরকারের উচিত মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স মানে জিরো টলারেন্স, এটা মনে রাখা। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় দেখে অভিযান করলে সুফল পাওয়া যাবে না।’

মাদকাসক্তি দূর করার জন্য সামাজিক ও পারিবারিক প্রচেষ্টাও জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন; খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫