
‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজন গ্রেফতার। ছবি: সংগৃহীত
লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’ ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশ থেকে প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। বাংলাদেশে অ্যাপ দুটি পরিচালনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গ্রেফতাররা হলেন- মোস্তাফা সাইফ রেজা (২৬), মো. আরিফ হোসেন (২৭), এস এম নাজমুল হক (২৭), আসমা উল হুসনা সেজুতী (২৮) এবং অজ্ঞাত এক বিদেশি নাগরিক। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, প্রাইভেটকার, বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
রবিবার (১৩ জুন) দুপুরে মালিবাগ সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সিআইডি সাইবার পুলিশের প্রধান ডিআইজি জামিল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এসব অ্যাপে ভিডিও স্ট্রিমিং লাইভ চ্যাট ও ফিসিং গেমের অপশন রয়েছে। এসব গেম ব্যবহারে প্রয়োজন হয় ‘ডায়মন্ড’ নামে এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। অ্যাপস ব্যবহারকারী লাখ লাখ বাংলাদেশি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছেন।
বাংলাদেশি বিভিন্ন এজেন্সি ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশি অ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
সিআইডির ভাষ্য, গ্রেফতার হওয়া বিদেশি নাগরিক বিগো লাইভ ও লাইকির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশি নাগরিক মোস্তফা সাইফ রেজা বিগো-লাইকির বাংলাদেশি অ্যাডমিন। গ্রেফতার হওয়া আরিফ হোসেন বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়েদের মাসিক বেতনে চাকরি দিয়ে বিগো লাইভের সঙ্গে যুক্ত করতেন। এস এম নাজমুল হক ভার্চুয়াল মুদ্রা ডায়মন্ড বিক্রির অন্যতম প্রধান বাংলাদেশি এজেন্ট এবং আসমা উল হুসনা সেজুতি বিগো লাইভের প্রধান অ্যাডমিন। অ্যাডমিনরা মাসে এক লাখ টাকা করে বেতন পেতেন।
ডিআইজি জামিল বলেন, লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপ বিগো লাইভ ও লাইকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়টি সিআইডির সাইবার পুলিশের নজরে আসে। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধের তথ্য প্রকাশ হয়। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির সাইবার পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করে।
তিনি বলেন, অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগো লাইভ ও লাইকিতে সাধারণত দেশের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভিডিও স্ট্রিমিং করেন। বিগো লাইভ অ্যাপে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি ব্রডকাস্টার আইডি ও অন্যটি সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডি। ব্রডকাস্টার আইডি ব্যবহার করে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং করে। এই ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে কথিত বিনোদনের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া হয়। সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডির মাধ্যমে যারা ভিডিও স্ট্রিমিং করত, তাদের ডিজিটাল কয়েন সদৃশ ডায়মন্ড গিফট করা হতো। পরবর্তী সময়ে এ ডায়মন্ড টাকায় রূপান্তরের মাধ্যম অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত।
লাইভ স্ট্রিমিংয়ে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার প্রলোভনে অ্যাপে প্রবেশ করেন সাধারণ ব্যবহারকারীরা। এজন্য ডায়মন্ড নামে একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয় ব্যবহারকারীদের। সাধারণত বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এ ডায়মন্ড কেনা যায়। সেই মুদ্রা উপহার হিসেবে দিয়ে আড্ডায় যুক্ত হতে পারেন ব্যবহারকারীরা। লাইভ ভিডিওতে যে যত বেশি অশ্লীল কথা বলতে পারবে তার ভিউ তত বেশি ও তত বেশি ডায়মন্ড উপহার।
সাইবার পুলিশের ডিআইজি বলেন, ডায়মন্ড সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে পৌঁছে দিত বিভিন্ন এজেন্সি। এরকম একাধিক এজেন্সি বাংলাদেশে রয়েছে। এসব এজেন্সির প্রত্যেকের একাধিক পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। সাধারণত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব এজেন্সির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এজেন্সির পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে ডায়মন্ড কেনেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম এসেছে এবং তাদের বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের অ্যাকাউন্টে গত এক বছরে প্রায় শত কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
জামিল আহমেদ বলেন, বিগো লাইভ থেকে ম্যাসেজ দিয়ে অথবা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে ডায়মন্ড কেনা সম্ভব। গ্রেফতার হওয়া এস এম নাজমুল হক মূলত বিদেশি এজেন্সির মাধ্যমে ডায়মন্ড কেনাবেচা করতেন। লাইকি ও বিগো লাইভ অ্যাপ বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা নিয়ন্ত্রণকারীদের এসব বিষয় নজরে আনব। এছাড়া আমরা এসব অ্যাপ সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি। যারা অশ্লীল ভিডিও দিচ্ছেন তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এসব অ্যাপের অফিস আমাদের দেশে খোলার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব।
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে আপাতত ব্যাংকগুলোর নাম বলছি না। তবে কোন কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা লেনদেন হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করছি।