
অশ্লীল ভিডিও তৈরিতে জড়িত লাইকি ও টিকটকারদের তালিকা করেছে পুলিশ। ফাইল ছবি
শ্যামপুরের সাদাতের বয়স ১৬ বছর। ইসলামপুরে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করে। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পায়। নয় মাস ধরে সে টিকটকে ভিডিও আপলোড করে আসছে। এ কাজে তার আছে বিচিত্র সব পোশাক ও সরঞ্জাম।
সাদাত জানায়, ‘ভালো লাগে তাই টিকটক করি। আমার ১১ হাজার ফলোয়ার আছে। তারা আমাকে লাইক-কমেন্ট করে। ভালোই লাগে। অনেকে শুনেছি বিভিন্নভাবে আয় করে। তবে আমার এখনো আয় হয়নি। খরচ আছে অনেক।’
সাদাত আরও জানায়, টিকটক করতে গিয়ে উত্তরা, মগবাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার কিশোরদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সারাদেশে আমাদের বন্ধু-বান্ধব আছে। তারা আমাদের সাপোর্ট করে। আমরা আবার তাদের সাপোর্ট করি। কি সাপোর্ট করে- এই প্রশ্নের উত্তরে সাদাত জানায়, টিকটকে এই ‘সাপোর্ট’ নিয়েই দ্বন্দ্বের শুরু। ‘সাপোর্ট’ অর্থ অন্যের ভিডিওতে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার দিয়ে ভিউয়ার বাড়াতে সহায়তা করা।
সাদাতের মতো আরও একজন কিশোরী সুমাইয়া (ছদ্ম নাম) থাকে মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুরে। টিকটক করে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে টিকটক বেছে নিয়েছে। বাবা-মা দু’জনই চাকরিজীবী। টিকটকে তার ফলোয়ার ২০ হাজার। এত ফলোয়ারের কারণে সুমাইয়া বেশ কিছু মিউজিক ভিডিওর কাজও করেছে। টিকটক সম্পর্কে সে জানায়, আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। স্কুল বন্ধ, বন্ধুরা মিলে মজা করছি। বন্ধু সার্কেল তৈরি হচ্ছে। মিডিয়াতেও কাজ করছি এই সুবাদে।
সাদাত আর সুমাইয়ার প্রযুক্তির এই অপসংস্কৃতির প্রতি আসক্তির কারণকে ব্যাখ্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, প্রযুক্তিতে যখন যেটা আসছে, সেটাই লুফে নিচ্ছে কিশোররা; কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের জায়গাটা তারা গুলিয়ে ফেলছে। এ কারণে কিশোরদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এর বদৌলতে কিশোর অপরাধ তৈরি হয়েছে, তা কিন্তু নয়, কিশোর গ্যাং অনেক আগে থেকেই রয়েছে। তবে এর ধরন বদলেছে। এ জন্য আমাদের পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাড়া-মহল্লার খেলাধুলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সুযোগ না থাকায় ছেলেমেয়েরা নেট দুনিয়াতেই পড়ে থাকছে। এখানে তাদের বয়সীদের মধ্যে খুব দ্রুত কানেকশন ও নেটওয়ার্ক হচ্ছে। এ কারণে খেয়ালের বশে অপরাধেও জড়াচ্ছে বেশি।
আইটি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চীনের তৈরি টিকটক অ্যাপটি মূলত স্মার্টফোনে ব্যবহারের। আর লাইকি তৈরি করেছে সিঙ্গাপুরের বিগো টেকনোলজি। এর মধ্যে টিকটক অ্যাপ তৈরি হয় ২০১৮ তে। আর ২০১৭তে তৈরি হয় লাইকি। স্মার্টফোনে সহজে ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় কম বয়সী ছেলে-মেয়ে ও তরুণরা এই অ্যাপগুলো বেশি ব্যবহার করে। টিকটকের ৪১ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছর। পৃথিবীতে ৪০টি ভাষায় ১৫৫টি দেশে চলত এই টিকটক অ্যাপ। বর্তমানে পৃথিবীতে এর সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮০ কোটির বেশি। টিকটকে বর্তমানে দুই থেকে আড়াই মিনিটের ভিডিও দেওয়া যায়। তবে শুরুতে ৫, ১০ ও ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও দেওয়া যেত।
ইতিমধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অশ্লীল ভিডিও তৈরিতে জড়িত লাইকি ও টিকটকারদের তালিকা করেছে। ৪০টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে তারা, যারা অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে। এসব ভিডিও দেখে তরুণ-তরুণীসহ শিশুরাও বিপথে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ওই সব টিকটক ও লাইকি নির্মাণকারী এবং এসব প্ল্যাটফর্মে অভিনয়কারীদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তাদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত চিরুনি অভিযান শুরুর কথাও বলছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কম গতির ইন্টারনেটেও টিকটক-লাইকি অ্যাপ চালানো ও ভিডিও আপলোড করার সুযোগ থাকায় বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এ কারণে ঢাকার বাইরে, এমনকি গ্রাম পর্যন্ত এদের ব্যবহারকারী বেড়ে চলেছে। র্যাবের সূত্র জানিয়েছে, টিকটক-লাইকিসহ বিতর্কিত অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। এসব লাইকি ও টিকটক তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রুপের একজন অ্যাডমিন থাকে। সেই অ্যাডমিনের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ১৫ জন তরুণ-তরুণী কাজ করে। এ পর্যন্ত ৪০টি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর তাতে পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণী জড়িত।
টিকটক ও লাইকির কারণে রাতারাতি তারকার খেতাব পেয়ে যাচ্ছেন অনেক কিশোর-কিশোরী। এসব তথাকথিত তারকাদের বয়স ২০ থেকে ২৫; কিন্তু কারা এই টিকটকের মাধ্যমে তারকা বনে যাচ্ছেন? তার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অ্যাপসটি যারা ব্যবহার করছে, তাদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টিকটকে আসক্তি হয়ে পড়েছে। টিকটক তারকাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা এলাকাভিত্তিক গ্যাং তৈরি করে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই গ্যাং খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে জোট বেঁধে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভ টিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। এমনকি কবরস্থানের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় টিকটক করতে এরা পিছপা হন না। রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গেলে প্রতিদিন এসব দৃশ্য চোখে পড়ে।
সাদেকা হালিমের মতো দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক টিকটক লাইকির আড়ালে অপরাধ কর্মকাণ্ডে শঙ্কিত। তারা সরকারের কাছে টিকটক বন্ধ করে তরুণ সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর আহ্বান করেছেন। তাদের মতে, লাইকি ও টিকটকের মাধ্যমে সমাজে পৌঁছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার ও কিশোর অপরাধ। আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও সামাজিক সহিংসতা। টিকটকের ফাঁদে পড়ে ঘটছে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা নারী পাচারের মতো ঘটনা। পুলিশের সাইবার দমন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অনেক অভিভাবক থানায় এসে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন। টিকটক ও লাইকি বন্ধে আদালতে শুনানি হয়েছে। সরকার থেকেও এটি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লাইকি ভিডিও ও টিকটকের নামে অশ্লীল কর্মকা- প্রতিরোধে নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ। লাইকি ও টিকটক আইডি অনুসন্ধান করে তালিকা তৈরির পর খোঁজ করা হচ্ছে বেশ কিছু তরুণ-তরুণীকে।
শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, অনেক দেশে এই টিকটক লাইকি নিষিদ্ধ হয়েছে। আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এর অপব্যবহার সবচেয়ে বেড়েছে। এখানে শিক্ষামূলক কোনো বার্তা নেই। এই যে যুব সমাজের মধ্যে এত অপরাধ বাড়ছে, তারও একটি অন্যতম কারণ এই টিকটক ও লাইকি অ্যাপ। এসব অ্যাপ দ্বারা নির্মিত ভিডিও দেখে বর্তমান যুবসমাজ তাদের চরিত্রকে কলুষিত করছে। চুল ও জামা-কাপড়ের নোংরা স্টাইলসহ কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহারে উগ্রতা এসব ভিডিও থেকেই শিখছে। সমাজে ইভ টিজিং ও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনেও এসব অ্যাপের ভিডিওর দায় রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহিত কামাল বলেন, টিকটক বা লাইকিতে যেসব ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে তার অধিকাংশই নৈতিকতা বর্জিত এবং মার্জিত আচরণের বিপরীত। এসব নিম্নমানের এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভিডিওর নির্মাণ, প্রদর্শন এবং অনুসরণের ফলে আগামী দিনে নতুন প্রজন্মের মাঝে আচরণগত অসুস্থতা পরিলক্ষিত হতে পারে। তারা স্বাভাবিক কথাও ব্যঙ্গ করে বলে। এ ছাড়া এসব একসময় বদভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।