Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ঘরে ঘরে করোনা রোগী

দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ায় দেশ

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১, ২১:১৬

দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ায় দেশ

ফাইল ছবি।

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ান্ত সময় পার করছে দেশ। দেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল গত বছরের জুনে। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তবে মে মাস থেকে আবার সংক্রমণ কমতে থাকলেও, সংক্রমণের হার ৫ এর নিচে আসেনি। জুন মাস থেকে আবার বাড়তে থাকে শনাক্তের সংখ্যা। চলতি মাসে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা, হার ও মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

এদিকে, সারাদেশে জ্বরব্যাধি বেড়ে গেছে। ঘরে ঘরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে জ্বরে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। এমনো বাড়ি রয়েছে যে ৬ সদস্যের পরিবারের সবাই জ্বরে আক্রান্ত। জ্বরে আক্রান্ত এসব রোগীর করোনা নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে তাদের করোনা পজিটিভ না নেগেটিভ তা জানা যায়নি। 

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষের করোনা নমুনা পরীক্ষা করা হয় তাতে সকলের নমুনা পরীক্ষা করতে ১০ বছর লেগে যাবে। মূলত গ্রামের মানুষের করোনার নমুনা পরীক্ষা এখনো শুরুই হয়নি। ফলে আক্রান্ত রোগীরা জ্বরের ওষুধ খাচ্ছেন। এর আগে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তিবাসীদের মধ্যে করোনার নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ঢাকায় ৭১ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ৫৫ শতাংশ মানুষের দেহে করোনার অ্যান্টিবডি রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, নির্দিষ্ট এই এলাকাগুলোতে কী পরিমাণ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে একটা ধারণা মিলছে এই জরিপের ফলাফলে। আইসিডিডিআর’বি বস্তিগুলোতে সমীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু গ্রামে এখনো করোনা নিয়ে কোনো নমুনা পরীক্ষা, গবেষণা কিছুই হয়নি।

এদিকে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে ৭টি বিভাগের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭টি বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫০টি নমুনায় ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট বি ১৬১৭ পাওয়া গেছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণে জর্জরিত এখন পুরো বাংলাদেশ। গত ৯ দিনে মারা গেছেন ১৫০১ জন আর আক্রান্ত ও শনাক্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৭৫ জন। ইতোমধ্যে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সংক্রমণে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই বেশি।

পাবলিক হেলথ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতে যেরকম আচরণ করেছে, বাংলাদেশেও তা-ই করছে। মানুষকে অধিক হারে সংক্রমিত করছে। আবার অনেকেই সংক্রমিত হয়ে বাড়িতেই থাকছেন। সংক্রমিত হওয়ার পর বুঝতে পারছে না, হাসপাতালে আসতেও দেরি করে ফেলছেন, যার ফলে দ্রুত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে। এখন আমাদের দেশের সর্বত্রই ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট আছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জুলাই নতুন করে ৮ হাজার ৩০১ জনের শরীরে ডেল্টা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এরপর ২ জুলাই ৮ হাজার ৪৮৩ জন, ৩ জুলাই ৬ হাজার ২১৪ জন, ৪ জুলাই ৮ হাজার ৬৬১ জন, ৫ জুলাই ৯ হাজার ৯৬৪ জন, ৬ জুলাই ১১ হাজার ৫২৫ জন, ৭ জুলাই ১১ হাজার ১৬২ জন, ৮ জুলাই ১১ হাজার ৬৫১ জন এবং গতকাল ৯ জুলাই ১১ হাজার ৩২৪ জন আক্রান্ত-শনাক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ গত ৯ দিনে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৭৫ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। তার আগের সপ্তাহে ৩৫ হাজার রোগী শনাক্ত হলেও পরে তা ৫৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে মৃত্যু বেড়ে যায় ৪৬ শতাংশ। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে হাসপাতালে খালি বেড আর আইসিইউর সংখ্যা। তাছাড়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারাদেশের ১৫ হাসপাতালে ভর্তি আছেন শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত রোগী।

জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নওগাঁ, নোয়াখালী, পাবনা, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও জেলায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনায় ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই জেলাগুলো ময়মনসিংহ বিভাগ ছাড়া দেশের অন্য ৭টি বিভাগের অন্তর্গত।

গত ৩ ও ৪ জুলাই বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) জিআইএসএআইডিতে ১৭টি জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করেছে। সেখানে তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, নওগাঁতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত নমুনা পাওয়া গেছে ১১টি, বাকিগুলো পাওয়া গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা এবং ঢাকায়।

এর আগে গত ১ জুলাই আইইডিসিআর ৩৬টি জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৬টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই পাওয়া গেছে সিলেট থেকে সংগ্রহ করা নমুনায়।

দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বি ১৬১৭-এর সামাজিক সংক্রমণের কথা আগেই জানিয়েছিল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত ৩ জুন প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পর্যায়ে জিনোম সিকোয়েন্স করে জানায়, সারাদেশে ৫০টি নমুনার মধ্যে ৪০টিতে ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, যা শতকরা হিসাবে ৮০ শতাংশ।

চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গত ২৬ জুন আপলোড করা জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের প্রাপ্ত ৬টি ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ৫টি ঢাকা বিভাগে এবং একটি কুষ্টিয়া জেলায়। ঢাকা বিভাগের মধ্যে আছে ঢাকা, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলা।

২১ জুনে আপলোড করা আইসিডিডিআরবি’র জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য বলছে, তারা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছে ৩৪টি নমুনায়। এর মধ্যে ১৬টি নমুনা ঢাকার। ঢাকার মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মধুবাগ ও মহাখালী এলাকার পাশাপাশি রাজবাড়ী এবং শরীয়তপুর আছে এই তালিকায়। তাছাড়া খুলনা, যশোর এবং রাজশাহীতে আছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া জেলার মধ্যে। এ পর্যন্ত ঢাকায় পাওয়া ৩৭টি ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের তথ্য সেখানে জমা আছে। আর সারাদেশের আছে ৯৫টি ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের তথ্য।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগী সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে।

এদিকে, শনিবার (১০ জুলাই) দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে এক শিশুসহ মারা গেছেন ১৮৫ জন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ১৮৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় কম নমুনা পরীক্ষায় কমেছে শনাক্তের সংখ্যাও। এ সময়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ৭৭২ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এসব তথ্য জানা যায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ হাজার ৮৮৪টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হন ৮ হাজার ৭৭২ জন, যাতে শনাক্তের হার ৩১.৪৬ শতাংশ। শুক্রবার পরীক্ষা করা হয় ৩৬ হাজার ৫৮৬টি নমুনা, যাতে শনাক্ত হন১১ হাজার ৩২৪ জন। শনাক্তের হার ছিল ৩০.৯৫ শতাংশ। এ নিয়ে মোট শনাক্ত ১০ লাখ ৯ হাজার ৩১৫ জন। এ পর্যন্ত মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, গত এক দিনে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ১২১ জন পুরুষ এবং ৬৪ জন নারী। নতুন মৃতদের মধ্যে ৭০ জনই ঢাকার। এছাড়া চট্টগ্রামে ২০, রাজশাহীতে ১৩, খুলনায় ৫১, বরিশালে ১০, সিলেটে ৭, রংপুরে ১১ এবং ময়মনসিংহে ৩ জন মারা গেছেন। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯২ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ৫১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ২২ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১৩ জন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের ৫ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন ও শূন্য থেকে ১০ বছরের একজন রয়েছেন। এ নিয়ে দেশে করোনার মৃত্যুর মোট সংখ্যা দাঁড়ালো ১৬ হাজার ১৮৯ জনে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫