
করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে দিন আনা দিন খাওয়া দরিদ্ররা পড়েছেন ভীষণ কষ্টে। ফাইল ছবি
‘ভাইজান, তিন বছর আগোত মোর স্বামী মরি গেইছে। রংপুর শহর ঘুরি ভিক্ষা করি খাও। অ্যালা তো গাড়িঘোড়া, দোকানপাট বন্ধ। গ্রামোত ভিক্ষা কইরার গেইলে কায়ও বাড়িত ঢুকপার দেয় না, করোনার কথা কয়। খিদার জ্বালাও তো সহ্য কইরার পাও না। অ্যালাও সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পানু না। ঘরোত বসি কি পানি আন্দি খামো, কন?’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন ৫০ বছরের বৃদ্ধা ওপিয়া বেগম। কথায় কথায় ওপিয়া জানালেন, কোনো জমিজমা নেই। দুমুঠো ভাতের জন্য এ বাড়ি ও বাড়ি ভিক্ষা করার জন্য যেতে হয় তাকে। ভিক্ষা পেলে মেলে ভাত, না হলে থাকতে হয় উপোস।
হোটেল–রেস্তোরাঁয় বাঁশের তৈরি খড়কে (টুথপিক) বিক্রি করে সংসার চালাতেন রংপুরের মান্দালা মিয়া। লকডাউনে হোটেল–রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ থাকায় উপোস থাকতে হচ্ছে তার পরিবারকে।
মান্দালা মিয়া বলেন, ‘বাবা, করোনা তো গরিব মানুষের কোমর ফেলে (ভেঙে) দিছে। আয়–রোজগার তো বন্ধ। ঘরোত খাবার নাই। কায়ও সাহায্য–সহযোগিতাও করোছে না। তাহলে বাঁচমো কী খায়া।’
লালবাগের গৃহবধূ রহিমা বেগম জানান, তার স্বামী নিউমার্কেটের ফুটপাতে জুতা বিক্রি করেন। স্বামীর ব্যবসার জন্য তিনি স্থানীয় একটি এনজিও থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধের শর্তে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। করোনার কারণে মার্কেট বন্ধ থাকায় স্বামীর রোজগার পুরোপুরি বন্ধ। স্বামী ও দুই সন্তানসহ পাঁচজনের তিন বেলার খাবারের টাকা জোগাড় করতে খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানান।
করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে এমন দিন আনা দিন খাওয়া দরিদ্ররা পড়েছেন ভীষণ কষ্টে। বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে না পারায় পরিবারগুলোর মানবেতর দিন কাটছে। সামনে কোরবানির ঈদ। দুবেলা খাওয়ার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত এই মানুষগুলোর ঈদ উদ্যাপন নিয়ে চিন্তাও করার সময় নেই।
রাজধানীর রায়ের বাজার এলাকায় সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দুই পাশে পৃথক লাইনে দাঁড়িয়ে শত শত নারী-পুরুষ টিসিবির পণ্য কিনতে অপেক্ষা করছেন। বাজার মূল্যের চেয়ে সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম দামে চিনি, মসুর ডাল এবং সয়াবিন তেল কিনতে এসেছেন তারা। প্রতি কেজি ৫৫ টাকা মূল্যে চিনি ও মসুরের ডাল এবং প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০ টাকা মূল্যে কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ালেও শেষ পর্যন্ত পাবেন কি না, তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে রয়েছেন।
টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর অধিকাংশই নিম্নআয়ের। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে লকডাউনের কারণে তারা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্থানীয় দোকানদার আলীম বলেন, ‘রোজগার বন্ধ হইলে কি অইবো, মাসটা শেষ হইতে না হইতে বাড়িওয়ালা ভাড়ার টাকা ও কিস্তির জন্য পাওনাদার এসে হাজির হয়। করোনার সমস্যার কথা বললেও তারা শোনে না। বরং দ্রুত পরিশোধের জন্য চাপ দেয়।’
রাজধানীর একটি মহল্লার ক্লাবে চাকরি করেন মানিকগঞ্জের লুৎফর রহমান। করোনার কারণে তার বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। আগে যা বেতন পেতেন তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। এখন বেতন অর্ধেক কমিয়ে দেয়ায় আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘চিন্তা করেছি আগামী মাসে পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে যাব। কারণ এত কম টাকায় ঢাকায় টেকা যাবে না।’
স্বামীহারা শেফালী বেগম। থাকেন হাজারিবাগে। ঘরে দুই সন্তান। হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করে সংসার চলে তাঁর। শেফালী বেগম বলেন, ‘বাহে, করোনা তো হামার মতোন গরিব মাইনষের পেটোত লাথি মারছে। কামকাজ না থাকায় ঋণ করি কষ্টে সংসার চলোছে। যায় চাকরি করে, তায় তো বেতন পাওছে। হামার মতোন গরিব মাইনষের ঋণ খালি বাড়োছে। এমন চললে তো হামাক না দেউলিয়া হয়া মইরার নাগবে।’
সুলতানা জামান নামে একজন মধ্যবয়সী নারী বলেন, ‘গরিব অইয়া জন্ম নেয়াটাই দোষ অইছে। মানুষকে এত কষ্ট দিয়ে আজ এখানে কাল সেখানে টিসিবির ট্রাক না পাঠিয়ে প্রতিটি এলাকায় ট্রাক পাঠানো গেলে মানুষকে এত কষ্ট করে বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো না।’
লকডাউনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি এবং জীবনযাত্রায় যে ছন্দপতন হয়েছে, তা–ও মানুষ মেনে নিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছে, করোনা থেকে মুক্তি পেতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের কারণে যেসব স্বল্প আয়ের, তথা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
লকডাউনে গরিব মানুষ আছেন উভয়সংকটে। ঘর থেকে বের হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আটক ও জরিমানা করে। আর ঘরে বসে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার তাদের নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে কাজ হারিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা হারিয়ে নতুন করে যে দুই–আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন, তাঁদের সহায়তায় সরকারিভাবে তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য সহায়তা হলো ৩৬ লাখ লোককে দুই দফায় আড়াই হাজার টাকা করে অনুদান। লকডাউনের কারণে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, যাঁদের অন্যান্য চাহিদা মেটানো দূরের কথা, দুমুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।