
করোনা বর্জ্য
শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে হাসপাতালগুলোর করোনা বর্জ্য। কিন্তু অতি সচেতন কয়েকটি হাসপাতাল এবং প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবখানেই এ নিয়ে একই ধরনের উদাসীনতার চিত্র দেখা যায়। অনেকেই করোনার সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহারের পর রাস্তাঘাটে ফেলে দিচ্ছেন। এগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যাচ্ছে ড্রেনে। ড্রেন থেকে নদী ও সাগরের তলদেশে গিয়ে নষ্ট করছে জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ। রাজধানীর বিভিন্ন গাছে, শহরের অলি-গলিতে ও ড্রেনে মাস্ক দেখা যাচ্ছে। হাতের গ্লাভসও যেখানে সেখানে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী এসব বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করে তারপর সুরক্ষা ব্যাগে (বায়োসেফটি ব্যাগ) ভরে রাখার কথা। হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া হাসপাতালগুলো যথাযথ পদ্ধতিতে বর্জ্য রাখছে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাস্ক পরা। জীবন বাঁচাতে আপাতত এর বিকল্পও নেই।
এমনিতেই বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। সাধারণ বর্জ্যের মতো যখন এগুলো উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয় তখন মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে। অন্যদিকে কভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট সুরক্ষা সামগ্রী মূলত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য। এসব পণ্য ভূমিতে বা পানিতে বছরের পর বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। বাসাবাড়িতে সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে কভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্য। যা ব্যবস্থাপনায় আলাদা উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত সিটি করপোরেশনের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রকার সুরক্ষা ছাড়াই করোনা বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, ডাম্পিং বা ধ্বংসের কাজ করছেন হাজারো পরিচ্ছন্নতাকর্মী। যারা যেকোনো মুহূর্তে সংক্রমিত হতে পারেন। সারা দেশে বহু করোনা রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা প্রত্যেকে মাস্ক-গ্লাভস ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো ঘরের ভেতরে যথাযথভাবে রাখা না হলে কিংবা গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে একত্রে একই ভাগাড়ে ফেললে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ছয় দশমিক ছয় ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩ ভাগ পড়ে থাকছে এখানে ওখানে!
মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে কাজ করে একটিমাত্র বেসরকারি সংগঠন- প্রিজম বাংলাদেশ। করোনার শুরুর দিকে তারা বিভিন্ন হাসপাতাল এবং বাসাবাড়িতে জমা হওয়া বর্জ্যের জন্য দুই সিটি করপোরেশনের সাথে একযোগে কাজ করছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানায়, শুরুর দিকে এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনে তৎপরতা থাকলেও এখন আর কেউ গা করছে না।
তিনটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন ২০৬ দশমিক ২১ টন করোনা বর্জ্য হচ্ছে। ৪৯ শতাংশের বেশি নগরবাসী অন্যান্য বর্জ্যরে সাথে করোনা বর্জ্য রাখে এবং সিটি করপোরেশনের কর্মীদের কাছে হস্তান্তর করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি দ্রুত সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলোকে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে। ধরনভেদে প্রতিটি বর্জ্য তার উৎসেই আলাদা করার ব্যবস্থা নেয়া, আলাদাভাবে সংগ্রহ, পরিবহন, ডাম্পিং ও ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাও।
সূত্রমতে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে রাজধানীতে ৫০০ হাসপাতাল আছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোথাও আধুনিক মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সলিউশন নেই। তবে এখানে করোনা চিকিৎসা হয় না। এর আগে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি হাসপাতালে ইনসিনারেটর মেশিনের মাধ্যমে এসব বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেগুলোও প্রায় অকেজো। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে এ ধরনের বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে হাসপাতালগুলো থেকে ময়লা নিয়ে কোথাও মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। কোথাও ফেলে দেয়া হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। কোথাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বাতাস বিষাক্ত করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সংক্রমণের শঙ্কা।
মাস্ক কিংবা গ্লাভসের দেখা মিলবে না নগরের এমন কোনো সড়ক পাওয়া দায়। পিপিইর মতো সংবেদনশীল সুরক্ষাসামগ্রীও ফেলে রাখা হয়েছে। এখান থেকে পেশাদার পরিচ্ছন্ন কর্মীর বাইরে থাকা প্রায় ৪০ হাজার পথশিশু এসব বর্জ্য থেকে বিভিন্ন জিনিস কুড়িয়ে বিক্রি করছেন বিভিন্ন লোকাল মার্কেটে। ফলে মনিটরিংয়ের আওতার বাইরে থাকা এসব টোকাইরাও রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। এছাড়া ব্যবহৃত সামগ্রী থেকে বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
মেডিসিন ও সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফুল বাশার বলেন, রাস্তার মধ্যে পড়ে থাকা মাস্ক এবং গ্লাভসে থাকা ভাইরাসটি খালি জায়গায় ২-৩ দিন বেঁচে থাকে। এই বর্জ্যের দ্রবণীয় ক্ষতিকর পদার্থ নানাভাবে মানুষের, স্থলচর ও জলচর প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। পুরো ব্যাপারটিই মানুষের অসুস্থতা এবং পরিবেশ দূষণের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
করোনার বর্জ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর গত বছরের ১৩ জুন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে ৫টি নির্দেশনা মানতে চিঠি দেয়। নির্দেশনায় প্রত্যেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে করোনা বর্জ্য আলাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, দুই স্তর বিশিষ্ট প্লাস্টিক ব্যাগের দুই-তৃতীয়াংশ এসব বর্জ্য ভর্তি করে ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বেঁধে আলাদা বিনে রাখতে হবে, বিনের গায়ে লেখা থাকতে হবে- কভিড-১৯ বর্জ্য। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অল্প সংখ্যক পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিলেও বেসরকারি হাসপাতালে এমন কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য অপসারণের কোনো তাগিদও নেই।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সারা দেশে বহু করোনারোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁরা প্রত্যেকে মাস্ক-গ্লাভস ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছেন। এগুলো ঘরের ভেতরে যথাযথভাবে রাখা না হলে কিংবা গৃহস্থালি বর্জ্যের সাথে একত্রে একই ভাগাড়ে ফেললে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি হবে বিরাট। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেকোনো অবহেলা ঘটলে গণসংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।