টেন্ডারের লোহার ব্রিজ হয়ে গেলো সুপারি গাছের সাঁকো

বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ১১:১৪

লোহার ব্রিজ, খুঁজে পাচ্ছে না স্থানীয়রা
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ৮নং উদয়কাঠী ইউনিয়নের মুনশী বাড়ির জন্য চার বছর পূর্বে একটি লোহার ব্রিজ অনুমোদন করিয়ে আনেন প্রবীণ আবু হানিফ। কিন্তু জীবদ্দশায় ব্রিজটি দেখে যেতে পারেননি তিনি। অথচ বরাদ্দের লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদার।
আবার অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বরিশাল জেলা পরিষদ থেকেও দাবি করা হয়েছে ব্রিজ নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়নি। শুধু ব্রিজটি খুঁজে পাচ্ছে না স্থানীয়রা। তাই সুপারি গাছ দিয়ে সাঁকো বানিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে মুনশী বাড়ির ১৪টি পরিবারের সদস্যদের।
কদিন আগে সাঁকো পাড় হতে গিয়ে শিশু সন্তানসহ খালের মধ্যে পড়ে যান এক গৃহবধূ। এর একদিন আগে একইভাবে খালে পড়ে আহত হয় আরেকটি শিশু। ফলে সাঁকোটি এখন মুনশী বাড়ির লোকদের দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জীবনের নিরাপত্তার জন্য হলেও চার বছর পূর্বে বরাদ্দকৃত টাকায় আয়রন ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা। পাশাপাশি লকডাউন শেষ হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ডেকে এনে প্রকল্প অনুসারে কাজ কেন হয়নি সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ‘উপজেলার পূর্ব উদয়কাঠী গ্রামের বাসিন্দা আবু হানিফ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে মূল সড়কের সাথে মুনশী বাড়ির চলাচলের জন্য একটি আয়রন ব্রিজ পাশ করিয়ে আনেন।
তার ছেলে নুরুল আমিন মুনশী বলেন, ‘আমরা জন্ম থেকেই সাঁকো দিয়ে চলাচল করতাম। বাড়ির সামনে যে খালটি রয়েছে সেটি অনেক বড়। বাবা দীর্ঘদিন চেষ্টা করছিলেন সেখানে একটি আয়রন ব্রিজ নির্মাণের। এমনকি তিনি জেলা পরিষদ সদস্য মাওলাদ হোসেন সানা’র মাধ্যমে একটি আয়রন ব্রিজ পাস করিয়েও আনেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাবা ব্রিজটি আর দেখে যেতে পারেননি। ব্রিজ নির্মাণের আগেই বাবার মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, বাবা মারা গেলেও ব্রিজটি আজও নির্মাণ হয়নি। শুনেছি ব্রিজটি নির্মাণের জন্য বরাদ্দও এসেছি। কিন্তু সাঁকোর পাশে একটি ভিত্তিপ্রস্তর ছাড়া আর কিছুই করেনি জেলা পরিষদ। আগের সুপারি গাছের সাঁকো দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে আমাদের।
মুনশী বাড়ির গৃহবধূ তাজেনুর বেগম বলেন, ‘আমি শুনেছিলাম ব্রিজটি নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। এরপর কিছুদিন আমি শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম না, বাবার বাড়ি শরণখোলা বেড়াতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি চারটি লোহার খাম্বা বসানো। এছাড়া বাকি যা আছে তা আগেই ছিলো।
তিনি বলেন, ‘এত বড় খালে এক লাখ টাকায় আয়রন ব্রিজ বানানো সম্ভব না। যারা আয়রন ব্রিজ বানাতে এসেছিলেন তারা যদি একটি কাঠের পোল বানিয়ে যেতেন তাহলেও আমাদের দুর্ভোগ দূর হতো। কিন্তু তারা যা করেছে সেটা না করলেও চলতো।
নাছিমা বেগম নামের অপর এক নারী বলেন, ‘জন্মের পর থেকে কখনো আমাদের মুনশী বাড়ির সামনে পোল দেখিনি। বছর কয়েক পূর্বে শুনেছি আমাদের এখানে পোল নির্মাণের জন্য সরকার এক লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছি। কিন্তু পোল আর নির্মাণ হয়নি। সাঁকো সাঁকোই রয়ে গেছে।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বরিশাল জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মানিকহার রহমান বলেন, আমি ২০১৯ সালে জেলা পরিষদে যোগদান করি। তাই পূর্বে কি হয়েছে সেটাও আমার জানা নেই। তাছাড়া বর্তমানে তিনি বরিশাল জেলা পরিষদ থেকে বদলি হওয়ায় এ নিয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
বরিশাল জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘চার বছর আগের কাজ এখনো পুরোপুরি স্মরণে নেই। তবে মুনশী বাড়ির সামনের খালটি অনেক বড়। এত বড় খালে একলাখ টাকায় আয়রন ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয়। তার পরও যে বরাদ্দ হয়েছে তাতে ঠিকাদার যতটুকু পেরেছে কাজ করেছে। এখন চারটি লোহার খাম্বা কিনতেই লাখ টাকার বেশি লাগছে। ওই খালে আয়রন ব্রিজ করতে কমপক্ষে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দরকার।
আয়রন ব্রিজ নির্মাণের কাজ পাওয়া ঠিকাদারের নাম পরিচয় বলতে না পারলেও এই কৌশলী বলেন, ‘টেন্ডারের পরে লটারিতে শহরের বাংলাবাজারের বাসিন্দা এক ঠিকাদার কাজটি পেয়েছিলেন। তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন এক লাখ টাকায় কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে যে টাকায় ঠিকাদার যতটুকু কাজ করেছে তাতে কোন অনিয়ম হয়নি বলে নিশ্চিত করেন সাবেক এই প্রকৌশলী। তবে তিন বছর আগে নির্মিত আয়রন ব্রিজটি কোথায় গেলো এমন প্রশ্ন করা হলে ‘ফাইল না দেখে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়’ বলে এড়িয়ে যান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন সানা বলেন, ‘ব্রিজটি আমিই পাস করিয়ে দিয়েছিলাম। টেন্ডার অনুযায়ী ব্রিজটি নির্মাণের বিষয়ে সাবেক প্রকৌশলী আমাকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে কি হয়েছে সে বিষয়টি আর খোঁজ নিতে পারিনি। লকডাউন শেষে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ডেকে বিষয়টি সমাধান করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।