Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

পানি ও স্যানিটেশনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২১, ১২:৩৮

পানি ও স্যানিটেশনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

ফাইল ছবি

খুব বড় গলায় বলা হয়ে থাকে স্যানিটেশন ও পানি ব্যবহারে বাংলাদেশ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কথাও সত্য। দেশে এমন একটা সময় ছিল, যখন এই স্যানিটেশন সম্পর্কে মানুষের ধারণাই ছিল না। ছিল না আগ্রহ। ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা কার্যক্রম, সরকারি পদক্ষেপ ও বেসরকারি উদ্যোগে সেই কালিমা থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। স্যানিটেশনে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। তারপরেও পুরোপুরি সফলতা আসেনি এই খাতে। তবে সেসব গর্বের সে দিন অনেকটা ফুরিয়েছে। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, পানিসম্পদের অপচয় ও শিল্পখাতে পানির ব্যবহার বাড়তে থাকায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। একইসঙ্গে সংকটে স্যানিটেশন খাতও। পানি ও স্যানিটেশন খাতের উন্নতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন চিত্রই তুলে ধরেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফ। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফের তৈরি ‘জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) প্রতিবেদন ২০২১’-এ এ চিত্র উঠে এসেছে। পানি ও স্যানিটেশন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সেখানে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে এ দুই খাতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলো। অথচ এ দুই ক্ষেত্রে আগে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব খাতে এখন শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে।  

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ মৌলিক স্যানিটেশনের সুবিধা পেত ২০১৫ সালে। ৫ বছর পর এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। গত ৫ বছরে এ খাতে পাকিস্তান, নেপাল ও ভারত, এই তিন দেশের অগ্রগতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ৫ বছর আগে পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ মানুষ এ সেবার মধ্যে ছিল। ৫ বছর পর তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে। নেপালে ১৮ শতাংশ বেড়ে মৌলিক স্যানিটেশনের কভারেজ দাঁড়িয়েছে ৭৭ ভাগে। ভারতে মৌলিক স্যানিটেশন ৫ বছর আগের চেয়ে ১৪ ভাগ বেড়ে ৭১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান। দেশটির জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ মৌলিক স্যানিটেশন-সুবিধা পাচ্ছে। 

জেএমপি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ এখনো অনুন্নত শৌচাগার ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একে একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এ হার যথাক্রমে ২, ৩ ও ১৪ শতাংশ।

নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ গত ৫ বছরে উল্লেখ করার মতো তেমন উন্নতি করেনি। বাংলাদেশে নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের হার ৩৯ শতাংশ; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো এগিয়েছে জোর কদমে। ভারত ৫ বছরে ৩৬ থেকে ৪৬ শতাংশে পৌঁছেছে। নেপালের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের সুযোগ পায়। মলের জীবাণু, আর্সেনিক ও অন্যান্য দূষণমুক্ত নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও, পাইপের মাধ্যমে সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ হওয়া পানিকে বেশি নিরাপদ এবং শহরের নাগরিক সুবিধার অংশ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ পাইপের পানি পায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ক্ষেত্রে নেপালের অগ্রগতি বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ, ৫০ শতাংশ। ভারতে এ হার ৪৪ আর পাকিস্তানের ২৬ শতাংশ। ২২ শতাংশ নিয়ে আফগানিস্তানের বর্তমান হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সরবরাহের পানি পায়। শহরে এ হার ৩৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালের গ্রামাঞ্চলে সরবরাহের পানি প্রাপ্তির হার সবচেয়ে বেশি। দেশটির ৪৯ শতাংশ মানুষ সরবরাহের আওতায় আছে। ভারতের গ্রামে এ হার ৩২ ও পাকিস্তানে ১৫ শতাংশ। সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থার মতো স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে পাকিস্তান। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা পায়। ভারত ও নেপালে এ হার ৬৮ ও ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি সুবিধা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা পায়। ভারত ও নেপালে এ হার ৬০ ও ৫৯ শতাংশ। পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি, ৭৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের বর্তমান স্যানিটেশন পরিস্থিতি বোঝার জন্য বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের স্যানিটেশন কার্যক্রমের গেল কয়েক বছরের তুলনা করা যেতে পারে। এক নজরে দু’দেশের স্যানিটেশনের শুরু থেকে বর্তমানের চিত্রপট তুলনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে ৭০ এর দশকে সরকারি উদ্যোগে নলকূপ এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার শুরু হয়। 

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, সে সময়ে বাংলাদেশে স্যানিটেশনের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ। নব্বই দশকের শুরুর দিকেও বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় পায়খানা করত। ২০১২ সালে তা প্রায় শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়ায়। তখন ঘোষণা দেওয়া হয় দেশের শতকরা ৯৯ শতাংশ নাগরিক শৌচাগারে মলত্যাগ করে। অন্যদিকে ভারতের স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা এতটাই নাজুক যে, ভারতের শৌচাগার মলত্যাগ নিয়েও কয়েক বছর আগে হাসাহাসির উপলক্ষ হিসেবে মজা করা হতো। 

দৃশ্যপটের ব্যাখ্যায় আরও একটু দেখা যাক। গেল ৫ বছর আগের ও পরের চিত্র কী বলছে। ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন- ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তখনকার সরকারি জরিপ বলছে, খোলা স্থানে মলত্যাগের হার ২০১৬ সালে মাত্র এক শতাংশে নেমে আসে। যা ছিল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। ভারতে তখনো প্রায় ৫৯৫ মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ টয়লেট ব্যবহার করত না। এরই ৪ বছর পর মানে ২০২১ সালে এসে এই একই দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ মৌলিক স্যানিটেশনের সুবিধা পেত ২০১৫ সালে। ৫ বছর পর এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। গত ৫ বছরে এ খাতে ভারতের অগ্রগতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ভারতে মৌলিক স্যানিটেশন ৫ বছর আগের চেয়ে ১৪ ভাগ বেড়ে ৭১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। বাংলাদেশে নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের হার এখন ৩৯ শতাংশ, যেখানে ভারতে ৫ বছরে ৩৬ থেকে ৪৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ পাইপের পানি পায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ভারতে এই হার ৪৪। বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সরবরাহের পানি পায়। শহরে এ হার ৩৬ শতাংশ। ভারতের গ্রামে এ হার ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশের গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি সুবিধা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা পায়। আর ভারতে এ হার ৬০ শতাংশ। 

পানিবিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ বলেন, পানি ও স্যানিটেশন খাতে কিছু অগ্রগতির পর এর গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরে ওয়াশ খাতে (পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি) তেমন জোর দেওয়া হয়নি। স্যানিটেশন ও হাইজিনের মান সারাদেশেই এখনো নিম্নপর্যায়ে রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলের মনুষ্য বর্জ্য নিষ্কাশনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে; কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব এখনো ব্যাপক। গৃহস্থালির স্যানিটেশন ও হাইজিনের বিশেষ উন্নতি ঘটেনি। তারা বলেন, শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, সে অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রায় শামিল হতে হলে আমাদের অবশ্যই এসব দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। তার আগে নিজেদের জন্য একটি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে বেশ উন্নতি হয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; নবজাতক ও প্রসূতিদের মৃত্যু হার কমেছে। তা সত্ত্বেও বলা যাবে না যে, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে এই খাতের অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশুদ্ধ বা নিরাপদ খাওয়ার পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কার্যকর পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাসস্থান-গৃহস্থালি ও কর্মস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি, পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। 

বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। নিরাপদ খাওয়ার পানির ঘাটতি একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও এই সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি অনেক এলাকার মানুষ নিয়মিত পায় না। দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে নিরাপদ পানির সংকট প্রকটতর হচ্ছে। অনেক এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি থাকা বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫