
ফাইল ছবি
দুই পর্বের শেষ পর্ব
দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র ক্যান্টিন : দেশে মোট কারাগার রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় এবং বাকি ৫৫টি জেলা কারাগার। এগুলোর ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ জন হলেও, কয়েদি ও হাজতি মিলে আছেন ৮৮ হাজার ৮৪ জন। তাদের দেখভালে রয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি কারারক্ষী। আর এতসংখ্যক বন্দিকে ঘিরে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের খাত কারা ক্যান্টিন।
যেখানে প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য কারবার হয়। কারাগারে সরকারিভাবে দেওয়া খাবারের মান খুবই খারাপ। তাও দেওয়া হয় নামেমাত্র। আবার নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রায় সময় স্বজনদের আনা খাবার-দাবারও ভেতরে নিতে দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ। তখন বাধ্য হয়েই বাজার দরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে খাবার এবং জামাকাপড় কিনতে হয় ক্যান্টিন থেকে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া, নাটোর, বরগুনা, নেত্রকোনাসহ দেশের বেশ কয়েকটি কারাগার ক্যান্টিনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় সামনে এসেছে।
বরগুনা কারাগার থেকে কিছুদিন আগে জামিনে বের হয়ে আসা রাফিন জোমাদ্দার জানান, সরকারি খাবারের মান খুবই নিম্ন। ভাতে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। সঙ্গে থাকা তরকারি যেন হলুদ-লবণ মেশানো টলটলে পানি, মাছ-মাংসের অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে জেলের ভেতরের ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। তাও একটা ডিম ৬০ টাকা, এক পিস পাঙ্গাস মাছ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি রান্না করে বিক্রি হয় ১৩০০ টাকায়। সেই তরকারির পুরোটা আবার দেওয়া হয় না। অন্যদের কাছেও সেটা বিক্রি করা হয়। গরুর মাংসের দাম রাখা হয় প্রতি কেজি ১৮০০ টাকা করে। কারাগারে মানুষ যে কতটা অসহায়, তা বলে বোঝানো যাবে না।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি কারাগারে গড়ে দৈনিক দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। যদিও কাগজে-কলমে এই বেচা-কেনা দেখানো হয় অর্ধেকের কম। লভ্যাংশের ৪০ ভাগ পাঠানো হয় কারা অধিদপ্তরের তহবিলে; কিন্তু এ অর্থ কোথায়-কীভাবে খরচ হয় তার কোনো অডিট হয় না। উল্টো টাকার ভাগাভাগি নিয়ে প্রভাবশালী কারা কর্মকর্তাদের মধ্যে সারা বছরই লেগে থাকে অদৃশ্য দ্বন্দ্ব। অথচ কথা ছিল, এসব টাকা কারারক্ষী এবং বন্দিদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
১০ মিনিট কথা বললে ৩০০ টাকা : নানা সময়ে কারাগার ঘুরে আসা বন্দিদের তথ্য, ভেতরে মোবাইল ফোনের হরেক নাম। কোথাও ‘চকলেট’, কোথাও ‘চিপস’, আবার কোথাও ‘মুঠো’ বলে ডাকা হয়। আড়াল করতেই এসব সাংকেতিক নাম। পুলিশ ও কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কারারক্ষীদের একাংশ বাইরের সিন্ডিকেট থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট জোগাড় করে বন্দিদের কাছে ভাড়া দেন। আদালতে যাতায়াতের পথে বা প্রিজন ভ্যানে ওঠানো-নামানোর সময় বন্দিদের একাংশও নানা কৌশলে মোবাইল নিয়ে ঢোকে কারাগারে। রক্ষীদের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ থাকলে ওয়ার্ড বা সেল পর্যন্ত সেটি নিয়ে যেতে সমস্যাও হয় না। আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক বন্দি হলে তো কথাই নেই, মোবাইল-ই যেন চলে আসে তাদের কাছে! এ ছাড়া অপরাধ জগতের প্রথম সারির অভিযুক্ত, আন্ডারওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ রাখা অপরাধীরা অন্ধকার জগতের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ফোন জোগাড় করে নেয়। কথা বলার সেই খরচ তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা দলের লোকজন নানা কায়দায় পৌঁছে দেয় ‘সঠিক গন্তব্যে’। মাঝে মধ্যে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলে নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। অভিযানে মোবাইল কিংবা সিম-কার্ড বাজেয়াপ্ত হয়; কিন্তু সমস্যা মেটে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩-১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিএনপি-জামায়াত জোটের কয়েকশ’ কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হন। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাদের আরাম-আয়েশে জেলখানায় থাকার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কারা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এরপরই অভিযান চালানো হয় কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। ভিআইপি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক কয়েদি ও হাজতিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, ইয়াবা, বিপুল পরিমাণ গাঁজা এবং কিছু রাইস কুকার, ব্লেন্ডার ও টি-হিটার ফ্লাস্ক। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের কাছেও তখন মোবাইল ফোন পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের গঠিত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। কারাগারে থাকা জঙ্গিরাও নিয়মিত মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা ও খুদে বার্তা আদান-প্রদান করে।
সম্প্রতি জামিনে মুক্ত এক বন্দি বলেন, ‘আমি জেলে ঢোকার পর বাড়িতে একটি নম্বর পাঠিয়ে দিয়ে বলা হলো, তাতে টাকা ভরে দিতে। যেমন- ধরুন, তিনশ টাকা ফ্লেক্সি দিলে কথা বলা যেত ১০ মিনিট। তার মধ্যে মোবাইল আর সিম কার্ডের ভাড়াও রয়েছে। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনা সহসা প্রকাশ করে না কেউ। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন প্রকার অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার কারাগারে যেতে হয়।’ এ প্রসঙ্গে উচ্চপদস্থ এক কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্দিরা সাধারণত আদালত থেকে ফেরার পথে জেলে বেআইনি জিনিস নিয়ে ঢোকে। এক্ষেত্রেও অসাধু কারারক্ষীদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং তল্লাশিতে ঢিলেমি না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারারক্ষীরাই বন্দিদের মোবাইলে কথা বলতে সাহায্য করেন।’
কাশিমপুর কারাগারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎকাচ, অনিয়ম, অনৈতিক কার্যক্রম ও কারাবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা। তাতে উঠে আসে, কারা কর্মকর্তাদের খুশি করতে পারলেই আসামিরা প্রিজনভ্যানের বদলে মাইক্রোবাসে করে আদালতে যাওয়া-আসা করতে পারেন। পাশাপাশি আসামির স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া হয় অনৈতিক সুবিধা, যাচাই না করেই তখন দুর্ধর্ষদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। বন্দিদের নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে তা স্বজনদের দেখিয়েও অর্থ আদায়ের তথ্য উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। ওই সময় বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও লাগাম টানা যায়নি সেই অনিয়মের।
দুদকের জালে টাকার কুমির : কারাগারের অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত চলছে। আর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে গ্রেফতার করে রেলওয়ে পুলিশ। ওই কারাকর্মকর্তা তখন জানিয়েছিলেন, এসব টাকা তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ককে (জেল সুপার) মাসোহারা হিসেবে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন কারা অধিদপ্তরের ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশীদ। পরে অবশ্য তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। তারও আগে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের এক সময়ের ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিককে ঘুষের ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে দুদক। তার ফ্ল্যাটের বিভিন্ন কক্ষে তোশক, বালিশের কভার এবং আলমারিতে লুকানোবস্থায় এ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। কারা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিদর্শক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই সেনাকর্তা অবশ্য দেশের বাইরে রয়েছেন। অধীন ও আশীর্বাদপুষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে নিয়োগ, টেন্ডার ও মাদকবাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে দুদকের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘কারা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতেই অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।’
সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব.) সামছুল হায়দার সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের কারাগারগুলোতে নানা অনিয়মের কথা সবারই কম-বেশি জানা। যে কারাগারে এক হাজারের বেশি বন্দি অবস্থান করছে, সেখানে কোনো না কোনোভাবে গড়ে উঠছে ভয়ংকর সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে অসাধু কিছু কারারক্ষী সরাসরি জড়িত থাকে। তাদেরকে বাইরে থেকে সাপোর্ট দেয় প্রভাবশালীরা। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
এ দিকে অনিয়মের গলাটিপে ধরতে দেশের সব জেলকে সিসিটিভির অধিক নজরদারিতে আনতে চাইছে কারা অধিদপ্তর। এ থেকে বাদ যাবেন না কারারক্ষীরাও; কিন্তু তাতে কি জেলের ভিতরে ‘সব কিছু’র আনাগোনা কমবে, যেখানে শর্ষের মধ্যেই ভূত! নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে শীর্ষ পদে যারা রয়েছেন, তাদের যোগসাজশ ছাড়া এসব অনিয়ম সংঘটিত হতে পারে না। তাছাড়া দু-চারজন কর্মচারীর লঘু শাস্তির মাধ্যমে কারাগারের ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা’ সারানো সম্ভব নয়। নানা দুর্নীতি-অনিয়মের কথা স্বীকার করে আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘আমি যোগ দেওয়ার পর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। ক্যান্টিনসহ যেখানে দুর্নীতির সুযোগ আছে, সেখানে অডিটসহ নানা মনিটরিং সিস্টেম চালু করছি। এ ছাড়া কারাগারকে সংশোধনমূলক কেন্দ্রে পরিণত করতে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে।’