
ফাইল ছবি
রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন শরীফুল ইসলামসহ পাঁচ বন্ধু। অন্য খাবারের সঙ্গে তারা পাঁচ বোতল কোমলপানীয়ও নেন। বিল দেওয়ার সময় দেখেন, বোতলের গায়ে থাকা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্য ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি তারা। পরে তাদের একজন সাঈদুর রহমান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে (ডিএনসিআরপি) অভিযোগ জানান। শুনানি শেষে রেস্তোরাঁটিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তার ভাগ পেয়েছেন সাঈদ নিজেও।
তবে ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মনে করে, ভুক্তভোগীদের খুব কমসংখ্যকই অভিযোগ নিয়ে অধিদপ্তর পর্যন্ত পৌঁছান। বাকিরা শুধু সয়ে যান। ভোক্তাস্বার্থ লঙ্ঘিত হলেও প্রতিবাদ করেন না। আসলে ভোক্তারা খুবই অসহায়। আমাদের দেশে ভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও নেই। ভোক্তাদের স্বার্থ দেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই মন্ত্রণালয় আবার ব্যবসায়ীদের স্বার্থও দেখে। ফলে ভোক্তাসংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণ, পণ্য ও সেবার দাম এবং মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি দেখে। তারপরও ডিএনসিআরপিকে নিয়ে বাংলার সেই জনপ্রিয় প্রবাদের মতোই বলতে হয়- ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’।
অধিকারে অজ্ঞ ভোক্তা : রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। রয়েছে ‘অধিকার’; কিন্তু ভোক্তার সেই অধিকার কী, তা জানেন না ভোক্তা নিজেই। প্রতারিত হলে কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে তাও অজানা। এমনকি ‘ভোক্তা অধিকার’ শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত নন অনেকে। যেসব সংগঠন বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, তাদের কার্যক্রম কেবল ভোক্তা অধিকার দিবসেই- আলোচনা, র্যালি, মানববন্ধনেই দায়সাড়া। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন- রাষ্ট্র শুধু আইন করলেই হবে না, এ আইন জানাতেও হবে। কারণ জনগণের জন্যই আইন। আর ভোক্তার যে অধিকার রয়েছে, তা তৃণমূল পর্যায়েও জানিয়ে দিতে হবে। কেননা নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম রাখা হলে এর জন্য যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যায়, তা গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া অধিকাংশরই অজানা। শুধু তাই নয়, পণ্যের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা না থাকা, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকা, ভেজাল পণ্য ও ওষুধ বিক্রি, ফরমালিনসহ ক্ষতিকর দ্রব্য মিশিয়ে খাদ্যপণ্য বিক্রি, ওজনে কম দেওয়া, রেস্তোরাঁয় বাসি-পচা খাবার পরিবেশন এবং মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অপরাধ। এ ছাড়া পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নির্মাণ, আবাসিক হোটেল ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কাজও অপরাধ। এ থেকে ভোক্তাকে সুরক্ষা দিতেই ২০০৯ সালে সরকার ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করে। প্রতারিত যে কেউ এ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। আদায়কৃত সেই জরিমানার ২৫ শতাংশ পান অভিযোগকারী।
সূত্র বলছে, প্রতিকার চেয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন। চলমান প্রতরণার তুলনায় সেটা যদিও একেবারে নগণ্য। অভিযোগকারী ভোক্তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। অভিযোগের প্রায় ৮০ শতাংশই পণ্যের মূল্য বেশি নেওয়া সংক্রান্ত। এর ৭০ শতাংশ কোনো না কোনো রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে।
অনলাইনে ক্রেতা ঠকানোর ফাঁদ : ‘লকনাউ ফ্যাশন’ নামে ফেসবুক পেজে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আগাম টাকা পরিশোধের মাধ্যমে একটি টু-পিস অর্ডার দেন মিম ইসলাম; কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য বুঝে না পাওয়ায় যোগাযোগ করতে গিয়ে তিনি দেখেন মোবাইল নম্বরটি বন্ধ, ফেসবুক পেজেও তাকে ব্লক মেরে দেওয়া হয়েছে। মিমের মতো লাখো মানুষ অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনলাইনের বাড়তি চাহিদা দেখে অনেক ভূঁইফোড় ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ থেকে পণ্য বিক্রির কথা বলে প্রতারণা করছে। সাইটে যে পণ্যের ছবি আছে, বাস্তবে সেটি দেওয়া হয় না। আবার পণ্যের ই-পেমেন্ট নিয়েও ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে না। করোনাকালে দেশে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরালহারে বেড়েছে এসব সাইবার অপরাধ। গেল বছর ই-কমার্সে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ১১ শতাংশের বেশি মানুষ। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এমন অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মোহাম্মদ সাইফুল আলম নামে এক প্রবাসী বলেন, অনলাইন ব্যবসা যারা করেন, তাদের ব্যাপারে কঠোর কিছু নিয়ম করা দরকার। যাতে ক্রেতার সঙ্গে দুই নম্বরি না করতে পারে।’
মোনালিসা চৌধুরী মুনা চাকরি করেন একটি আইটি ফার্মে। ঢাকার অসহ্য জ্যাম ঠেলে মার্কেটে গিয়ে কাপড় বাছাই করার সময় তার একেবারেই কম। তাই কাজের ফাঁকে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম থেকেই চটজলদি কিনে ফেলেন প্রয়োজনীয় পোশাকসহ সংসারের নানা জিনিসপত্র। গেল মাসে একটি ফেসবুক পেজ থেকে মুনা থ্রি-পিস অর্ডার দেন। সময়মতো বাসায় ডেলিভারিও আসে; কিন্তু পণ্য হাতে পাওয়ার পর মাথায় হাত, যে ড্রেস তিনি অর্ডার করেছিলেন তার সঙ্গে এর কোনোরকম মিল নেই। পরে অভিযোগ জানিয়ে ওই অনলাইন মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তারা পণ্য পরিবর্তন বা ফেরত নিতে অস্বীকার জানায়। তাই মুনা এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন। পরামর্শ করেছেন একজন আইনজীবীর সঙ্গে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মশিউর রহমান বলেন, ‘অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হলেও দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি এবং প্রতারণার অভিযোগে ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে। এ ছাড়াও অভিযোগ জানানো যাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। এর জন্য অনলাইনে পণ্য কেনার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমে। প্রতারিত হওয়ার পর এটাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।’
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার ভোক্তাবান্ধব বেশ কিছু আইন করেছে। এগুলোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে পৃথক মন্ত্রণালয় করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সমন্বয় করতে একক কোনো মন্ত্রণালয় নেই। এ জন্য অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ‘বিজনেস অ্যাফেয়ার্স’ ও ‘কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্স’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ করা যেতে পারে।’
ভোক্তার পুরস্কার কোটি টাকা : অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভোক্তাদের অভিযোগ জমা পড়েছে ৬ হাজার ৮২৭টি। অথচ সাত বছর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭৯টি। সাত বছরে অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে ৫১ গুণের বেশি। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর আরও জানায়, ২০০৯-১০ সাল থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভোক্তাদের অভিযোগের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭৯টি। পর্যায়ক্রমে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৯৫টি। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৪০টি অভিযোগ আসে। অভিযোগ নিষ্পত্তির হার শতভাগ। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভিযোগ আসে ২৬৪টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬২টি; যা বিগত বছরগুলোতেই নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আর অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছে মোট ৩৯ হাজার ৮০১টি। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৯০৯টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তিহীন এবং তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে ১ হাজার ৮৯২টি অভিযোগ। আলোচিত সময়ে অভিযোগের নিষ্পত্তি করে জরিমানা করা হয় ৪ কোটি ৭০ লাখ ৮৬ টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৬৪৫ ভোক্তা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫২ টাকা। প্রতিষ্ঠা থেকে সবশেষ গেল ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে ১০ হাজার ৯৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ডিত করে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭০ কোটি ২৫ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪২ টাকা। নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণোদনা হিসেবে ৬ হাজার ৭৩৩ অভিযোগকারীকে ১ কোটি ১৭ লাখ ২৪ হাজার ১০২ টাকা দেওয়া হয়।
জানা যায়, সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয়েছে অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণের অপরাধে (ধারা ৪৩)। এ অপরাধে ২১ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করায় জরিমানা করা হয়েছে ১৩ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করায় ১০ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার টাকা, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রির অপরাধে ৫ কোটি ১২ লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং ওজন বা পরিমাপের কারচুপির অপরাধে ৫ কোটি ৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহা বলেন, ‘প্রথম দিকে জনগণ এই আইন সম্পর্কে সচেতন না থাকায় অভিযোগের সংখ্যা কম ছিল। ভোক্তা অধিকার নিয়ে গণশুনানি ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির পর অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। সীমিতসংখ্যক জনবল ও সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে দেশব্যাপী ভোক্তা-অধিকার সুরক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিকতার কারণে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশাও বেড়েছে বহুগুণ। বিভিন্ন অনিয়ম-অভিযোগ পেয়ে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে জরিমানা নয়, আমাদের উদ্দেশ্য ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সচেতন করা। প্রয়োজনীয় লোকবল পেলে আমাদের এ কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হবে।’ জনগুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরটিতে লোকবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আমার অনেকটাই এগিয়েছি; কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও সময় লাগবে।’