
প্রতীকী ছবি
সব মানুষ এক রকম নয়, এ কথাটি সবাই জানি; কিন্তু আমাদেরই নানা আচরণে, কথায়, প্রতিক্রিয়ায় আমরা এই বিষয়টিকে অস্বীকার করি। কারও শরীরের আকৃতি, গঠন বা বর্ণের কারণে আমরা তাকে খোঁচা দেই, অপমান-অপদস্থ করি।
স্থুলতার কারণে ‘মটু’ বা ‘মটকু’, ‘ভোটকা’; একটু বেশি স্লিম হলে ‘চিকনা’, ‘পাতলু’, ’শুটকি’; বেশি দীর্ঘকায় হলে ‘লম্বু’, ’খাম্বা’; খর্বকায় হলে ‘বেটে’, ‘পিচ্চি’ ইত্যাদি নানা নামে-উপনামে ডাকি। এমনকি শরীরের রঙের কারণেও ‘কালা’, ‘কাইল্যা’, ‘ধলা’; মাথায় চুল কম থাকলে ‘স্টেডিয়াম’, ‘টাকলু’; চোখে চশমা পরার জন্য ‘চশমু’, ‘কানা’, ‘ট্যারা’; কারও একটু পেট মোটা হলে, ‘পেটুয়া’ ইত্যাদি উপনাম ধওে ডাকি। কারও কারও সহজ-সরল আচরণের কারণে শুনতে হয় ‘হাবলু’, ‘মফিজ’- এমন সব উপনাম। কী আপন-কী পর সবাই এমনটা করেন। কখনো কখনো এসব আরোপিত অপমানজনক পরিচয়ের আড়ালে অনেকের নিজের নামটাও হারিয়ে যায়।
এ ছাড়া আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের বিশেষ শারীরিক গড়ন ও বর্ণকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এটাও প্রকারান্তরে বডি শেমিংয়ের প্রসার ঘটায়। বিয়ের পর বৌ বা বরের শরীরি গড়ন নিয়ে পাড়া-মহল্লার সবার আলোচনা জরুরি হয়ে ওঠে। ফলে দেখা যায় ‘কৃষ্ণকলির বিয়ে হওয়া মুশকিল’, ‘রোগা ছেলেকে তালপাতার সেপাই’ বলে বিদ্রুপ করা এগুলো ভাষা, সাহিত্য এমনকি প্রবাদেরও অংশ হয়ে উঠেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, প্রিয় সহপাঠীরাই এসব অসহনীয় আচরণ করেন বন্ধুদের সঙ্গে। স্থুলকায় শরীরের বান্ধবীকে প্রায় অন্যরা টিপ্পনি কেটে বলে, ‘কোন দোকানের চাল খাস?’। একসঙ্গে খেতে বসলে কম খেলেও শুনতে হয় নানা কথা, বেশি খেলে তো টিপ্পনির শেষ নেই। আবার এর প্রতিবাদ করলে বন্ধুরাই বলে, ‘তুই এত সিরিয়াস কেন? আমরা তো মজা করছিলাম’। আধুনিক ডিকশনরিতে এসব অপমানকর আচরণকে বলা হয় ‘বডি শেমিং’।
এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকাও ছাত্র-ছাত্রীকে ‘গাধা’, ‘গরু’, ‘গবেট’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেন। যদিও এভাবে বদনামে ডাকাকে ‘অমানবিকীকরণ’ বা ডিহিউম্যানাইজেশন বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। হয়তো অনেকেই এটা স্বীকার করতে চাইবেন না; কিন্তু একটু নজর দিলে দেখা যাবে, ‘বডি শেমিং’ এখন আমাদের সমাজের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। অনেকের ক্ষেত্রে এটা এমন মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, ভুক্তভোগী অনেক সময় এটাকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আবার কেউ কেউ এসব আচরণের চাপ সহ্য করতে না পেরে নানা সংকটের মধ্যে পড়ছেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া, এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এই সমস্যার শিকার হয়ে।
এর জ্বলন্ত উদাহরণ রাজধানীর বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আজওয়াদ আহনাফ সামিন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কুলে সহপাঠীরা, শিক্ষকরা তাকে বুলিং করতো। স্কুলের খেলায় অংশ নিতে চাইলেও শিক্ষকরা তাকে বুলিং করেন। তারপর থেকে সামিন খুব বেশি হতাশ হয়ে পড়ে এবং ওজন কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তার বাবা-মা প্রথম দিকে তার ওজন কমানোর চেষ্টায় খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি তার সন্তান কীভাবে মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। পরে ছেলেটি মারা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সে অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা নামের একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, যা ব্যক্তির মনোজগতে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ভয়াবহ ভীতি ও নানা ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে।
সমাজবিজ্ঞানীরা একে এক ধরনের নিপীড়ন বলে মনে করেন। কোনো কোনো দেশে অবশ্য আইনিভাবেই শরীর নিয়ে মন্তব্য করাকে যৌন হয়রানি হিসেবে মনে করা হয়। নরওয়ের সমাজতাত্ত্বিক ইয়োহান গালটুংয়ের মতে, কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার (Structural Violence) মাধ্যমে ব্যাখ্যা করলে এই বডি শেমিংকে এক ধরনের সহিংসতাও বলা যায়। এই তত্ত্ব মতে, ‘সরাসরি আঘাত বা যখম না করেও সামাজিক কাঠামোর নানা নিয়ম ও চর্চার বেড়াজালে কাউকে কষ্ট দেওয়া যায়। এই সহিংসতার কারণে দৃশ্যত রক্তক্ষরণ হয় না; কিন্তু নীরবে-নির্ভৃতে মানুষের মন ভাঙতে পারে, মৃত্যুও হতে পারে। সমাজে বিরোধ-সহিংসতা ও অশান্তিও বিরাজ করতে পারে।’ সমাজে শৃঙ্খলা ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, এই কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার অবসান ঘটানো জরুরি বলেই মনে করা হয়।
বিশ্লেষকরা বডি শেমিংয়ের নানা কারণ বিশ্লেষণ করে থাকেন। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপন প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এর নীরব বিস্তার ঘটানো। যেমন- কয়েক বছর আগে একটি ফার্নিচার কোম্পানির বিলবোর্ডে বলা হয়েছিল, ‘স্লিম ইজ বিউটিফুল’। এখনো শরীরের আকৃতির ভিত্তিতে নায়ক-নায়িকার সৌন্দর্য বিবেচনা করা হয়। কোন নায়িকা কত কেজি ওজন কমিয়েছেন, সেগুলো খবরের শিরোনাম হয়। আরও মারাত্মকভাবে এই কু’চর্চায় ভূমিকা রাখছে, কার্টুনগুলো। শিশুদের কোমল হৃদয়ে এগুলো নানাভাবে ‘বডি শেমিংয়ের’ উপাদানগুলো প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে। কার্টুন ক্যারেক্টর হিসেবে মোটু-পাতলুর মতো নাম এর বড় প্রমাণ। এগুলো সবই পরোক্ষভাবে ‘বডি শেমিং’ নামের এই সহিংসতার পেছনের সামাজিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে।
এমতাবস্থায় বডি শেমিং প্রতিরোধে সামগ্রিক উদ্যোগ নেওয়ার বিকল্প নেই। এই নির্যাতনের শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে, যে কাঠামোর মধ্যেই বড় সংস্কার আনা প্রয়োজন। এ জন্য প্রথমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কাউন্সিলিং, বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে এবং অন্যের বাস্তবতাকে শ্রদ্ধা করতে শেখানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শিক্ষকদের শুধু পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এসব মানবিক ও সুদূর প্রসারী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। পাঠ্যবইয়ে এ বিষয়ে অধ্যয় সংযোজন করাও যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, নাটক-সিনেমার ও গণমাধ্যমের প্রভাবে যেন এ সমস্যার প্রচার ও প্রসার না ঘটে, বরং যেন এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে- সেটা নিশ্চিত করা দরকার। যদিও ফেসবুক-ইউটিউবের অবাধ স্বাধীনতার যুগে সেন্সর আরোপ করার সুযোগ খুব একটা নেই; কিন্তু ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় এনে নির্মাতা, লেখকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সবার নিরাপত্তার বিষয়ে সহমর্মী করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে অগ্রগতি আনা খুবই জরুরি। তা হলো, যে কেউ এমন সহিংসতার শিকার হলে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। এ জন্য আইন প্রয়োগ ও বিচার চেয়ে তা প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও দায়বদ্ধ করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী আজওয়ার মৃত্যুর ঘটনাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২২ আগস্ট হাইকোর্টে আইনজীবী তানভীর আহমেদের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা শিক্ষা অফিসারকে। পাশাপাশি মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে বুলিং রোধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা এবং খামখেয়ালিপনাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। বুলিং রোধে একটি নীতিমালার গুরুত্বও তুলে ধরেছে হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এই আদেশটি বুলিং প্রতিরোধের একটি আইনি অগ্রগতি হিসেবে ধরে এটি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন অনেকেই।