
ছবি- সংগৃহীত
ট্রাফিক ব্যবস্থা ও যানজট পরিস্থিতি নিয়ে নানা কথাবার্তা, গবেষণা হলেও দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে রাজধানী ঢাকার যানজট। বছরে বছরে অনেকসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ দেওয়ার পরেও উন্নত হচ্ছে না ঢাকা শহরের দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।
দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন তুলে দেওয়ার পর থেকেই যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাতে প্রচুর সময় নিয়ে বের হয়েও সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং কাজ শেষ করতে পারছেন না নগরবাসী। বরং লকডাউন শিথিলের পর ট্রাফিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন রাজধানীবাসী।
মোবাইল ফোনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচলের মাত্রা অনেক বেড়েছে। কোনো গাড়িই এখন বসে নেই। করোনা থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই এসব গাড়ি ব্যবহার করে নিরাপদে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যার কারণে রাস্তায় সব ধরনের যানবাহনের চাপ বেড়ে গেছে। আবার রাস্তা উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ যেমন- মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও গ্যাসের বিভিন্ন কাজ চলমান থাকার কারণেও অর্ধেক রাস্তায় যান চলাচল করতে পারছে না।
এদিকে করোনার শুরুর সময় থেকে রাজপথে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো অচল। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১০টি সিগন্যাল পয়েন্টের মধ্যে সচল মাত্র একটি। ৬৫৪টি সিগন্যাল পোস্টের প্রায় তিন হাজার রঙিন বাতি অকেজো। সিগন্যাল পোস্ট থাকলেও বেশিরভাগে বাতি জ্বলে না। এ পরিস্থিতিতে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে; কিন্তু বাস্তবে তেমন কাজ হচ্ছে না। ফলে অনেক পোস্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের খোঁজ মেলে না। এতে প্রতিনিয়ত যানজট দীর্ঘ হচ্ছে।
ট্রাফিক বিভাগের মতে, ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের চলাচল। তাদের জন্য ট্রাফিক পুলিশ থাকার কথা প্রায় ১০ হাজার; কিন্তু আছে মাত্র ৩৮০০ জন। এসব কারণে শত চেষ্টা করেও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বিভাগটির সদস্যরা। তাই প্রায়ই যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
তেজগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট শরীফ আহমেদ সনেট সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘আমরা ট্রাফিক পুলিশ খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনা করছি; কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তার পরিমাণ দিন দিন কমে যাওয়ায় এবং প্রতিদিন রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।’ অকেজো ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সিগন্যাল বাতিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের না। এগুলোর দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশন।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল সূত্রে জানা যায়, সিগন্যালগুলো ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এসব সিগন্যাল পয়েন্টকে কেন্দ্র করে পুলিশের জন্য বক্স-টয়লেট তৈরির পরিকল্পনাও আছে; কিন্তু এসব সচল না থাকায় কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া যাচ্ছে না।
সিগন্যাল বাতির প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সব পয়েন্ট অচলাবস্থায় আছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও গত মার্চে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না।
হাত দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘বাঁশের কঞ্চি আর বাঁশি দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা দেশের জন্য খুবই লজ্জার। মনে রাখতে হবে- এমন কাজের জন্য সাধারণ মানুষ, পথচারী এবং যান চালকরা আইন লঙ্ঘনে উৎসাহী হয়।’
যানজট রাজধানী ঢাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা। দিন যত যাচ্ছে এ সমস্যা ততই বাড়ছে। এখন তা আজ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে উত্তরণ ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯’ এর তথ্য ও আরও বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বের যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে ঢাকা, যা কখনোই সুখকর নয়। যানজটের এই সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই নগরীর লোকসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যাও। সে তুলনায় বাড়েনি সড়কের সংখ্যা, আয়তন ও পরিধি। যেখানে একটি পরিকল্পিত নগরীর মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ এলাকা সড়ক থাকা দরকার, সেখানে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ।
তাছাড়া দেশের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান ঢাকায় হওয়ার কারণে রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ বাড়ছে। প্রতিদিন গ্রাম বা অন্যান্য শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় ঢুকছে। এটিও যানজটের অন্যতম কারণ।
পিকআওয়ারে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে অজ্ঞানতা, ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্যতা, মানসম্পন্ন গণ-পরিবহনের অপ্রতুলতা, চালকদের আইন না মানার মানসিকতা, ফুটপাত শতভাগ পথচারীবান্ধব না থাকা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তা দখল করে তার ওপর দোকানপাট বসানো এবং স্বল্প খরচের বা বিনা খরচের টেকসই সিদ্ধান্ত না নিয়ে অপরিনামদর্শী উচ্চ বাজেটের মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়াকে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বাধা হিসেবে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এসব বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল হক আরও বলেন, ঢাকা শহরের যানজট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হলে সবার আগে বলতে হবে পিক আওয়ারে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আমাদের এখানে যারা মেগাসিটি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন, তারা বেশিরভাগই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জ্ঞান নেই। এত কম মেধা দিয়ে একটি মেগাসিটির যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। পিক আওয়ারে অর্থাৎ যে সময়ে অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজ শুরু ও ছুটি হয়, ঠিক সে সময় যদি রাজপথে যানবাহনের চলাচল স্বাভাবিক রাখা যায়, তখন বুঝতে হবে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে কাজ করছে; কিন্তু ঢাকা শহরে তা মোটেও পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি প্রচুর বাজেটে তৈরি হওয়া শহরের সবগুলো ফ্লাইওভারের ওপরেও পিক আওয়ারে যানজটের সৃষ্টি হয়। একই চিত্র দেখা যায় ইউলোপ ও ইউটার্নগুলোতেও।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের এখানে রাস্তার ধারণক্ষমতা অনেক কম সেহেতু আমাদের বিকল্প ছোট ছোট ব্যবস্থার চিন্তা করতে হবে। যা হবে কম খরচের বা খরচবিহীন চিন্তা; কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর। সবার প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তাহলো ছোট ছোট ব্যক্তিগত গাড়িকে নিরুৎসাহিত করা। সরকারিভাবে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত গাড়ির লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দেওয়া। লাইসেন্স যদি দিতেই হয় তাহলে পরিবারের সদস্যসংখ্যা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে নতুন করে গাড়ির লাইসেন্স দেওয়া। পাশাপাশি, গণপরিবহনকে একটি কোম্পানির আওতায় এনে মানসম্মত যানবাহনের মাধ্যমে নাগরিকদের যাতায়াত ব্যবস্থাকে উন্নত ও সহজ করা। এ ছাড়াও ফুটপাতগুলো পথচারীবান্ধব হিসেবে তৈরি করা, সর্বদা ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা। ফলে ফুটপাত ব্যতিত মানুষ কখনো রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটবে না। যার দরুন রাস্তার ওপর চাপ অনেকাংশেই কমে যাবে। তাছাড়া নগরীর যত্রতত্র পার্কিং বন্ধ করতে হবে। রাস্তায় অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখলে রাস্তা সরু হয়ে পড়ে, ফলে নগরীর রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন বুয়েটের এই শিক্ষক।
রাজধানীর বিশৃঙ্খল গণপরিবহনগুলো রাস্তার মোড়ে মোড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে অবৈধভাবে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করে। এ বিষয়টিকেও তিনি নগরীর যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন।
ঢাকায় যানজট কমাতে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গঠিত ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি’ সম্প্রতি আন্তঃজেলা বাস পরিষেবার জন্য ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে ১০টি বাস টার্মিনাল স্থাপনের প্রস্তাব করেছে। যাতে করে আন্তঃজেলা বাসগুলো রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং বাসগুলো নির্ধারিত বাস টার্মিনালে যাত্রী নামাবে। তারপর যাত্রীরা অন্যান্য পরিবহন ব্যবহার করে শহরের যার যার গন্তব্যে পৌঁছাবে।
তবে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তারা মনে করেন এটি জনদুর্ভোগ বাড়াবে। এ বিষয়ে পরিবহন পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ড. আদিল মোহাম্মদ খান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘আন্তঃজেলা বাসকে ঢাকায় প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে ভুল। কারণ এটি মানুষের দুর্ভোগ এবং পরিবহন খরচ বাড়াবে। আমি মনে করি, আন্তঃজেলা বাসগুলোকে কেবল ঢাকা শহরে ঢুকতে দেওয়া উচিত; কিন্তু যাত্রী ওঠানো ও নামানোর জন্য এবং প্রস্তাবিত টার্মিনালগুলো উদ্বৃত্ত বাসের পার্কিং এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির মতে, সায়েদাবাদ, মহাখালী এবং গাবতলী টার্মিনালগুলোতে ১ হাজার ৫০০ বাস ধারণক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু এখন এই তিনটি টার্মিনালে প্রতিদিন ৯ হাজার ২৯৮টি বাস রাখা হয়। আরও কয়েক হাজার বাস শহরের বিভিন্ন রাস্তায় পার্ক করা থাকে। এটি যানজটের একটি বড় কারণ। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কমিটি শহরের উপকণ্ঠে ১০টি নতুন টার্মিনাল প্রস্তাব করেছে।