Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

কয়েলের ধোঁয়ায় আঁধারে ভবিষ্যৎ

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:১৫

কয়েলের ধোঁয়ায় আঁধারে ভবিষ্যৎ

রাজধানীর চকবাজারকে ঘিরে নকল পণ্য তৈরির অসংখ্য কারখানা। কোনোটিতেই সাইনবোর্ড নেই। কোনো কোনো ভবনের গেটে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। এমন একটি বাড়ির নিচতলায় ঢুকে দেখা যায়, আলো জ্বলছে নিভু নিভু। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। আট থেকে বারো বছরের অনেক শিশু কয়েল তৈরির কাজে ব্যস্ত। পাশেই পড়ে আছে লিজার্ড, অ্যাকশন, ম্যাক ফাইটার, পরিমা, দাদাগিরি, রয়েল কিং নামে কয়েকটি কোম্পানির মোড়ক। শিশু শ্রমিকদের দিয়ে মাত্রারিক্ত বিষাক্ত ডি-এলেথ্রিন মিশিয়ে তৈরি হয় নিম্নমানের কয়েল। পরে তা বিভিন্ন মোড়কে ভরে বাজারে ছাড়া হয়, যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিটি প্যাকেটের গায়েই আবার ‘বিএসটিআই’র সিল! অথচ কারখানাটিরই কোনো অনুমোদন নেই।

বিশেষজ্ঞরা জানান, কয়েলের কাজ মশা তাড়ানো, মেরে ফেলা নয়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে কয়েলে সর্বোচ্চ ০.০৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট’ ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। মশা তাড়ানোর জন্য এ মাত্রাই যথেষ্ট কার্যকর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনুমোদন ছাড়াই উৎপাদন ও বাজারজাত করা কয়েলে শুধু মশাই নয়; বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকিও মারা যায়। আর এতেই বোঝা যায়, এসব কয়েলে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হারে ‘অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট’ ব্যবহৃত হচ্ছে; যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

অথচ কোম্পানিগুলোর মোড়কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রারই উল্লেখ থাকে! আর দীর্ঘদিন এসব কয়েল ব্যবহারে হতে পারে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালিতে প্রদাহ, কিডনিতে জটিলতা, ক্যান্সার, চোখে সমস্যাসহ অনেক রোগ। নারীদের গর্ভস্থ শিশুরও বিকলাঙ্গতাসহ মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, কয়েলে সহনশীল মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কম। তবে অধিকাংশ কোম্পানি তা না মানার কারণে নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। অবাক হলেও সত্য, কয়েকটি কারখানার মালিক জানান, বেশি রাসায়নিক না দিলে মশা মরে না!

কাঁচামালে টেনারি বর্জ্য

রাজধানীর টেনারিগুলোতে প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়া থেকে গড়ে প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন লিটারের মতো অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন হয়। আর এসব সস্তা বর্জ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে মশার কয়েলের কাঁচামাল। এতে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এক বস্তা বর্জ্যে তৈরি হয় ৪০০ পিস কয়েল। ফরমালিন-আর্সেনিকের মতোই এসব রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।

অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব কারখানায় সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যেই অভিযান চালানো হয়। এর পরও অজ্ঞাত কারণে আইনের ফাঁক-ফোকরে বেঁচে যায় অবৈধ কয়েল কোম্পানির মালিকরা। অথচ বালাইনাশক অধ্যাদেশ (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এর পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইর অনুমতি নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হয়।

এক কয়েলেই ১৩৭ সিগারেটের সমান ক্ষতি

বদ্ধঘরে টানা ৮ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখলে সামান্য একটি মশার কয়েলের ধোঁয়া ১৩৭টি সিগারেটে থাকা নিকোটিনের চেয়েও ক্ষতিকর। তা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া কয়েলে জড়িয়ে থাকা গুঁড়া এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা সহজেই শ্বাসনালি এবং ফুসফুসের পথে গিয়ে জমা হয়ে বিষাক্ততা তৈরি করে। এক সময় তা ব্রেন ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া কয়েলের ধোঁয়া চোখের ভীষণ ক্ষতি করে, দীর্ঘদিন ব্যবহারে তা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।

ভারতে হওয়া এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, কয়েল ব্যবহার করে মশা মারতে গিয়ে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জার্মানির ল্যুরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, কয়েল তৈরিতে যে কাঠের ও নারিকেলের মালার গুঁড়া ব্যবহার হয়, তার ধোঁয়া এতই সূক্ষ্ম যে, তা সহজেই আমাদের শ্বাসনালি ও ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যে পৌঁছে জমা হতে পারে। এমনকি সূক্ষ্ম কণাগুলো কয়েকদিন বাতাসেও ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ, মশার কয়েল নেভানোর বহু সময় পরেও ঘরে অবস্থানকারীর শ্বাসনালিতে তা ঢোকার সম্ভাবনা থাকে। এটা পরিবেশে মিশে যাওয়ায় প্রাণীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। তাছাড়া সব মশার কয়েলেই থাকে অ্যালেট্রিন, যা মস্তিষ্ক ও রক্তের স্বাভাবিক তৎপরতা ব্যহত করে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘কয়েলের ধোঁয়া থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বের হয়, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা গর্ভবতী নারী ও শিশুর বেশি ক্ষতি করে। সাধারণ মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। এছাড়া গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয়, একটি মশার কয়েল থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, তা একশটিরও বেশি সিগারেটের ক্ষতির সমান। এতে ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, হাঁপানি, এলার্জি ও স্তন ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।’ 

প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব

মশা যেমন জটিল রোগের জীবাণু বাহক, তেমনি এ কীট নিধনের কয়েলও শিশু ও মায়ের জন্য ক্ষতিকর। এতে ব্যবহৃত সব কেমিক্যালই মানবস্বাস্থ্যের ধ্বংস ডেকে আনে। গর্ভাবস্থায় যেসব মা মশা তাড়াতে কয়েল ব্যবহার করেন, তাদের শিশুরা ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি, শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। এমনকি গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গও হয়ে যেতে পারে। 

এ বিষয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নওশিন শারমিন পূরবী বলেন, ‘অতিরিক্ত মাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি মশার কয়েল প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব কয়েলের ধোঁয়া মশা মারছে ঠিকই, কিন্তু তা মানুষের প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে গর্ভপাতের হার। পুরুষের শুক্রাণু কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে প্রিম্যাচিউরড বাচ্চার জন্মহার।’ 

ক্যান্সারের ঝুঁকিতে কয়েল শ্রমিকরা

কয়েল কারখানার শ্রমিকদের ঝুঁকি আরো মারাত্মক। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মশার কয়েল তৈরি করতে গিয়ে তারা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে মূল্যবান শ্রম বিনিয়োগ করছে, তা নিজেরাই জানে না। চীনে এমন একটি কারখানায় দেখা গেছে, ৫ বছরের মধ্যে সব শ্রমিকের ক্যান্সার হয়েছে। কারণ কয়েলে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলো কখনো ধ্বংস হয় না। ছাই পানিতে মেশে সেটা আবারো মানুষের শরীরে আসার সম্ভাবনা থাকে।

আর দেশে অনুমোদনহীন কারখানাগুলোতে কম পারিশ্রমিকে শিশুদের দিয়েই বিষাক্ত কেমিক্যাল ও দ্রব্য মিশিয়ে কয়েল তৈরি করা হয়। চকবাজারের একটি প্রতিষ্ঠানে কথা হয় শিশু শ্রমিক রাজনের সঙ্গে। তার বাড়ি চাঁদপুর। তাদের ছেড়ে চলে গেছেন বাবা। মাও আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। এখন নানির কাছেই থাকে সে। অভাবের সংসার, খেয়ে-পরে বাঁচতেই কয়েল কারখানায় কাজ নিয়েছে বছর আটের রাজন। তবে এ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রায় সময়ই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু রাজনই নয়, এ অবস্থা প্রায় সব শ্রমিকেরই।

বদ্ধ ঘরে ধোঁয়া উড়িয়ে মৃত্যুর শাঁখ

শীতকালে মশার প্রকোপ বাড়ে। তাই অনেকেই এদের হাত থেকে বাঁচতে বদ্ধ ঘরেই মশার কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমান। এটা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ এ রকম ক্ষেত্রে ঘর থেকে দূষিত হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। ফলে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এতে মৃত্যুর ঘটনাও নেহাত কম নয়।

বছরের মাঝামাঝিতেও চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলের রুমে মশার কয়েলের ধোঁয়ায় মৃত্যু হয় খোকন দত্ত নামে এক প্রৌঢ়ের। আসলে যেসব মশার কয়েলে ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে মশা মারা যায়, ভোক্তারা সেই কয়েলেরই ব্যবহার বেশি করেন। অথচ তারা জানেন না, কয়েলের ধোঁয়ায় দ্রুত মশা মরলেও এটি মানবদেহের জন্য বেশি ক্ষতিকারক। আবার কেউ কেউ মনে করেন ধোঁয়াবিহীন মশার কয়েলে তেমন সমস্যা নেই। তাদের জন্য জানা দরকার, ওইসব কয়েল থেকে বিশাল পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয়, যা ফুসফুসের জন্য ভয়ানক। 

দেশের সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাহারি নামের নানা ধরনের মশার কয়েল অনেকটা অবাধেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার দোকানপাটে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকসমৃদ্ধ এসব কয়েলের অধিকাংশেরই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। কিন্তু আমরা তো অনুমোদনের বাইরে যেতে পারবো না, চাইলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কয়েল বাজারে ছাড়তে পারি না। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাই ধীরে ধীরে আমাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানতো কারখানাই বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এখন আসলে কয়েলের বাজারে দুষ্টদের রাজত্ব চলছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশে চীন থেকেও প্রচুর পরিমাণে মশার কয়েল আমদানি হচ্ছে। চীনারা খুব কম মূল্যে যে কোনো পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করে। এসব পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, সেটা নিয়ে তারা ভাবে না। অথচ উন্নত দেশে রপ্তানিকৃত চীনা পণ্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫