
১৬ ডিসেম্বরের প্রভাতে বাংলাদেশের টুইটার ট্রেন্ড ছিল ‘মহান বিজয়’। এ সংক্রান্ত অসংখ্য পোস্টের মধ্যে দেখা গেল ভারতীয় হাইকমিশনারের রুটিন অভিনন্দন।
পাশাপাশি ‘ভারত পুনরুত্থান’ নামের একটি অ্যাকাউন্টের টুইটে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের এ ঐতিহাসিক দিনে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। সারাবিশ্বের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে এ দিনটি আমাদের উৎসাহ দেয়।’ ওই অ্যাকাউন্টে ঢুকে দেখা গেল মুসলিম বিদ্বেষ আর হিন্দু আধিপত্যবাদের ব্যাপক তৎপরতার চিত্র। উদ্ধৃতিটি দুটো বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের।
এক. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও ভারতীয়দের সহযোগিতার সমন্বিত বয়ান প্রচার করতে ভারতের অনেকেই নারাজ। বরং নানা কৌশলে ইতিহাসের অর্ধসত্যের প্রপাগান্ডায় তাদের ঢের আগ্রহ।
দুই. ১৯৭১ সালের এই দিনে ভারতের দুই প্রান্ত-বিস্তৃত একটি দেশ ভেঙে দুটি আলাদা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সৃষ্টি হয়েছিল। পূর্বপাশে ‘বন্ধু’ বাংলাদেশ আর পশ্চিম পাশে ‘শত্রু’ পাকিস্তান- এভাবেই ভাবা হয়েছিল ভারতের ভূরাজনীতি।
৪৯ বছর পর সেই ভারতীয় বয়ানে বাংলাদেশকে ‘আরেকটি পাকিস্তান’ বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। সদ্য পাস হওয়া ভারতীয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের মধ্যে কোনোই তফাৎ নেই। বস্তুত ১৯৭১ সালের সাফল্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে স্বীকার না করে ভারত বাংলাদেশকে মিত্র হিসেবেই অস্বীকার করে। সম্প্রতি পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, নতুন ভিসা ব্যবস্থায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এক করে দেখা এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ মাত্র। গত অর্ধশতাব্দীব্যাপী এটাই দেশটির শাসকরা বিশ্বাস করে এসেছে, যদিও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা তা বুঝতে চায়নি, বা পারেনি। তাদের পরম মিত্রই ভেবে এসেছে।
গত এক মাসে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো, যা নির্দেশ করছে যে- বাংলাদেশ আর পাকিস্তানকে একই মানদণ্ডে মূল্যায়ন করছে ভারত সরকার।
দুই.
ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কোনো বিদেশি ভারতে অবস্থান করলে নিয়মানুযায়ী জরিমানা দিতে হয়। বছর খানেক ধরে এ জরিমানা সংক্রান্ত নিয়ম পরিবর্তন করেছে ভারত। নতুন চালু করা এ নিয়মে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে বৈষম্যমূলক পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত ১০ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অমুসলিম সম্প্রদায় (সংখ্যালঘু) মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসা নিয়ে অবস্থান করলে যে জরিমানা দিতে হয়, এই দেশগুলোর কোনো মুসলিমকে তার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি জরিমানা দিতে হবে।
ভারতের বিদেশি নিবন্ধন দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অমুসলিমদের কেউ ভিসার মেয়াদের পর ২ বছরের বেশি অবস্থান করলে ৫০০ রুপি, ৩ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত সময় অবস্থান করলে ২০০ রুপি আর ৩ মাসের কম অবস্থান করলে ১০০ রুপি জরিমানা দিতে হবে।
অন্যদিকে ওই তিন দেশের কোনো মুসলিম নাগরিক ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ২ বছরের বেশি অবস্থান করলে ৫০০ ডলার বা ৩৫ হাজার রুপি, ৩ মাস থেকে ২ বছরের কম হলে ৪০০ ডলার বা ২৮ হাজার রুপি ও ৩ মাসের কম মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থান করলে তাকে ৩০০ ডলার বা ২১ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দু লিখেছে, ‘এর অর্থ হচ্ছে লিটন দাস ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর অতিরিক্ত অবস্থান করলে তাকে ১০০ রুপি দিতে হবে। আর একই ক্রিকেট দলের সাইফ হাসানকে এক্ষেত্রে ২১ হাজার রুপি দিতে হবে, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের ভিন্নতার কারণে।’
কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কলকাতা সফরের সময়ে এই বিষয়টি প্রথম বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাইফ হাসানের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছিল কিছুদিন আগে। তিনি বিষয়টি কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারকে অবহিত করেন। ডেপুটি হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভারতের এফআরআরও-তে যোগাযোগ করা হয়। পরে ওই ক্রিকেটারকে ২১ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হয়।
বাংলাদেশি এক কূটনীতিকের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সম্প্রতি এক দরিদ্র মুসলিম নারী তার ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর একদিন বেশি অবস্থান করেছিলেন। তখন তার কাছে ২১ হাজার রুপি চাওয়া হয়, যা হাইকমিশনের কর্মকর্তারা সংগ্রহ করে দেন।
তিন.
সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় সমালোচনা সত্ত্বেও বিজেপির সংখ্যাধিক্যের জোরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-২০১৬ পাশ করা হয়। এ আইনটির মূল উদ্দেশ্যে বলা হয় ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়া। কিন্তু শুরু থেকেই দায়িত্বশীল বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মকে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করা ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের ওপর একটি বড় আঘাত।
প্রতিবেশী দেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের প্রতি মানবিক বিবেচনা এ আইনের উদ্দেশ্য বলে দাবি করা হলেও এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এনআরসির ফলে নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলা হিন্দুদের ফের নাগরিকত্ব দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে বিজেপির অবস্থান ঠিক রাখা। সেই সঙ্গে মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা করে রাখা। এ আইনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হওয়া নানা প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভের প্রসঙ্গ আলাদাভাবে আলোচনার প্রয়োজন।
আজকের শিরোনামের আওতায় আলোচনা করা প্রয়োজন যে কিভাবে এ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিরোধিতা আর বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সমগোত্রীয় বিবেচনা করা হচ্ছে। এ আইনটি পাসের আগে বিল আকারে লোকসভায় উপস্থাপনের সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বলেই এই তিন দেশকে একই কাতারে দাঁড় করিয়েছেন।
চার.
ওপরের ঘটনাবলির সঙ্গে আরেকটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন সামনে আনা প্রয়োজন। গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলা এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে বহু মানুষ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। গত মাসে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকে তিন শতাধিক মানুষকে আটকও করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আব্দুর রহমান বিবিসিকে বলেছেন, ‘যারা ধরা পড়ছে, তার তিনগুণ বেশি ধরা পড়েনি। তারা যে বর্ণনা দিচ্ছে তাদের নাম ঠিকানায় যা জানা যাচ্ছে, তারা বেশিরভাগই মুসলিম। তারা আতঙ্কগ্রস্ত এবং আমার যেটা মনে হচ্ছে, ভারতের এনআরসির প্রভাবেই তারা এখন সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসছে। এমনকি বিএসএফ এই মানুষদের বর্ডার ক্রস করার জন্য সহযোগিতা করছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।’ এ কারণে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
পাঁচ.
শুরু থেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশকে বলা হচ্ছিল যে, আসামের এনআরসি বাংলাদেশে কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা নেই। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এক সঙ্গে দেখলে প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবনা এড়ানোর সুযোগ নেই। সেই দেশভাগের সময় থেকে বলা হচ্ছিল, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থাকলেও ভারত হবে সর্বজনীন। বহুত্ব, বৈচিত্র্য এগুলোই ভারতের বৈশিষ্ট্য বলে শেখানো হচ্ছিল। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র সম্পর্কে এ ধারণাগুলো হয়তো ভুল ছিল।
দেশভাগের সময় ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল। কিন্তু ভারত অবশিষ্ট ছিল এমন এক ধারণা নিয়ে, যা ছিল অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন বিজেপি একের পর এক হিন্দু আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছেন, তা ভারতকে শুধুই ‘হিন্দুদের দেশ’ বানাতে মরিয়া হয়েছে।
যেমনটা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সমালোচনায় ভারতের রাজনীতিক ও বিশ্লেষক শশী থারুর বলেছেন, ‘১৯৪৭ সালে বিভাজন হয়েছিল ভারতীয় ভূমিতে। এবার বিভাজন হলো ভারতের হৃদয়ে।’
বলা প্রয়োজন, এখনো ভারতে অসাম্প্রদায়িক ভাবনার অনুসারীরা আছে বটে। কিন্তু তাদের ক্ষীণ কণ্ঠের চেয়ে সাম্প্রদায়িকতার আক্রমণ সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। দিল্লির জামিয়া-মিলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশি হামলা তারই চিত্র বহন করে।