Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

সমুদ্র সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ

এখনো ঢেউ গুনছে বাংলাদেশ!

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৫১

এখনো ঢেউ গুনছে বাংলাদেশ!

প্রতীকী ছবি

বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর। ভারতের কন্যাকুমারী থেকে মিয়ানমার, মাঝে বাংলাদেশ। ছুঁয়েছে শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডকেও। নয়নাভিরাম জলরাশি। আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ডুব দিলেই অন্যজগৎ, সীমাহীন সম্পদ। খনিজ, জ্বালানি জমে আছে সাগরের হৃদমাঝারে। 

‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্র অর্থনীতিকে নাগালে আনাটাই এখন আসল কাজ। ঐশ্বর্যকে টেনে তুলতে পারলেই ফুলে ফেঁপে উঠবে দেশের অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে বিরোধ ছিল তিন দেশের মধ্যে। ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে ভাগাভাগির সমস্যা মিটেছে। বাংলাদেশের ভাগে যা পড়েছে তা বিশাল, ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। হাতে আছে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অধিকার। চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩০৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপানের তলদেশে কী নেই? 

বিপুল প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়েও দামি বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ধাতব উপাদান। তাছাড়া সিমেন্ট বানানোর উপযোগী প্রচুর ক্লে রয়েছে তলদেশে। তেল-গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে। এখন শুধু প্রযুক্তিগত উদ্যোগটা নিখুঁত হওয়া চাই। পাশের দেশ মিয়ানমার এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। গ্যাস তোলা চলছে নির্বিঘ্নে। ভারতও বসে নেই। আর বাংলাদেশ পরিকল্পনার নামে শুধু সাগরের ঢেউ গুনে চলেছে কেবল!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল ভূ-খণ্ডের প্রায় সমান এই সমুদ্রাঞ্চলের সম্পদ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারেও হতে পারে সহায়ক; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এখনো প্রাথমিক পদক্ষেপের মধ্যেই আছে বাংলাদেশ। বিদেশি কোম্পানিগুলো নানা সময়ে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালেও পেট্রোবাংলা সে সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি।

সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে নেওয়া একাধিক উদ্যোগ বারবার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আটকে গেছে। কয়েকটি প্রকল্প ঝুলে রয়েছে এক দশক ধরে। এমনকি তেল-গ্যাস আহরণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’-এর ভিত্তিতে সমুদ্র ব্লকের ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও বিস্ময়করভাবে থমকে আছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জ্বালানি খাতে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে এসব ক্ষেত্রে সরকারের সুর্নিদিষ্ট পরিকল্পনার অভাব। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা দেশের সমুদ্রসম্পদ হোক বা অফশোর-অনশোর যে কোনো জায়াগায় নিজস্ব খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানি করতেই বেশি পছন্দ করেন। নিজেদের স্বার্থে ক্রমান্বয়ে দেশকে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ভবিষ্যৎ প্রভাব খুবই খারাপ হবে।’

জ্বালানি বিভাগ যদিও দাবি করছে, সাগরের সম্পদ আহরণে বর্তমানে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী সংকট ছিল। হয়তো থাকবেও। তবে এতদিন জ্বালানি নিয়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ৭১০ কিলোমিটার সুদীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র তথ্যানুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রফতানি করেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। সৃষ্টি হতে পারে বিপুল কর্মসংস্থান।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল হক বলেন, ‘২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও, এখন পর্যন্ত আমরা সমুদ্রকে কাজে লাগাতে পারিনি। মেরিটাইম লক্ষ্য এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের সমুদ্রের তলদেশে খনিজ বালুসহ কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা নিরূপণ করা যায়নি আজও। এমনকি মৎস্যসম্পদেরও উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারিনি আমরা। সঠিকভাবে যদি মৎস্যসম্পদ গ্যাস ও খনিজসম্পদ এবং স্কুবা ট্যুরিজম কাজে লাগাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে যে বাজেট হয় তা সমুদ্র অর্থনীতি দিয়েই জোগান দেওয়া সম্ভব। শুধু সামদ্রিক মাছ ও শৈবাল রফতানি করেই দেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারবে।’ 

একাধিক বিদেশি কোম্পানি সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করলেও, পরে তা শেষ না করেই চলে যায়। মূলত পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকলে বড় কোম্পানিগুলো সমুদ্রে অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না। এক্ষেত্রে মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও খনিজসম্পদের অবস্থানের একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে পূর্ণাঙ্গ জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় মাল্টিক্ল্যায়েন্ট সার্ভের কাজ ঝুলে আছে প্রায় ছয় বছর। এমন জটিলতার মধ্যে নিজেরাই জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা করে জ্বালানি বিভাগ। হাতে নেওয়া হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প। এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। পরে অবশ্য জাহাজ না কিনে ভাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। 

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ১১টি, গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। অগভীর সমুদ্রের ৯ নম্বর ব্লকে ১৯৯৬ সালে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি। গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। তবে মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালের দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। দু’বছর অনুসন্ধান কাজ করার পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মতভেদের কারণে ২০১৪ সালে তারা ব্লক দুটি ছেড়ে দেয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য আরেক আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ ব্লক তিনটির জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট অয়েল। পরবর্তীতে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

একই সময়ে অগভীর সমুদ্র্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছিল। এ ছাড়া সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারে দ্বিমাত্রিক জরিপ করে। আর ৩০২ বর্গকিলোমিটারে ত্রিমাত্রিক জরিপ করে তথ্য পেট্রোবাংলার কাছে দেয়। একটি কূপ খননেরও কথা চলছিল। পরে অবশ্য তারা বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।

এদিকে বিশেষ আইনে দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে আগ্রহপত্র চায় পেট্রোবাংলা। সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি, দক্ষিণ কোরিয়ার পোসকো দাইয়ু ও নরওয়ের স্টেট অয়েল আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে প্রস্তাব চাওয়া হলে শুধু গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকের জন্য প্রস্তাব দাখিল করে দাইয়ু। দীর্ঘ আলোচনার পর কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) সই করে পেট্রোবাংলা। সেই কাজের মধ্যেই পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদন করে দাইয়ু; কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী দাম বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় পেট্রোবাংলা তা নাকচ করে। এরপরই দাইয়ু তাদের ব্লক ছেড়ে দেয়।

তার আগে অবশ্য ৩ হাজার ৫৮০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করে পেট্রোবাংলার কাছে তথ্য দিয়ে গেছে তারা। এই ব্লকটি খুবই সম্ভাবনাময়। এই ব্লকের পাশেই মিয়ানমারের থালিন-১ নামক ব্লকে গ্যাস আবিষ্কার করে দাইয়ু। ওইটি অনেক বড় গ্যাসক্ষেত্র। সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস রয়েছে তাতে। এই মজুদ আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। ওই গ্যাস এখন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে চীনেও রফতানি করছে দেশটি। অথচ সেই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুদ কেবল মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাই যত দেরি হবে উদ্যোগ নিতে ততই প্রাকৃতিক ওই সম্পদ হারাবে বাংলাদেশ। সময়ে সময়ে পাতালের গ্যাস তুলে নিয়ে যাবে প্রতিবেশী। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাভরি বেসিন এলাকাতেও প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। 

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বানে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে; কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা করা যাচ্ছে না।’

অন্যদিকে অনসন্ধান কাজ ফেলে রেখেই দুই বিদেশি কোম্পানির চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দাইয়ু অযৌক্তিক গ্যাসের দাম বাড়াতে বলে, চুক্তি অনুসারে যা সম্ভব নয়। এরপর তারা চলে যায়। আর সান্তোস তো পুরো এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫