Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মানুষ আতঙ্কে বন্যহাতি

Icon

রফিক মজিদ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ১৩:০০

মানুষ আতঙ্কে বন্যহাতি

বন্যহাতির আক্রমণ

দীর্ঘদিন থেকে শেরপুর জেলার গারো পাহাড়ি এলাকার নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরর্দী উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ বন্যহাতির আক্রমণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এক সময় সন্ধ্যা নামলেই সাধারণ গ্রামবাসী হাতি তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। স্থানীয় প্রশাসন সীমান্তবাসীকে হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচাতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং স্থানীয় প্রশাসন হাতি তাড়াতে বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করে কাঁটাযুক্ত বেত, বড়ই গাছ ও লেবু গাছ রোপণ, মরিচের গুড়া ছিটানো, আগুনের কুন্ডলি জ্বালিয়ে হাতির উপর নিক্ষেপ, সেলার ফেন্সিংসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এসব কিছুই ভেস্তে যায় হাতির আক্রমণের কাছে। ফলে মানুষই হয়ে উঠে হিংস্র। তাই বর্তমানে সীমান্তের বন্য হাতির দল এখন মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।  

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে শেরপুর সীমান্তের উল্লেখিত উপজেলায় হাতির আক্রমণে প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় প্রায় শতাধিক মানুষ। সেইসাথে শত শত ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত এবং কয়েক কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। ফলে সীমান্তবাসী এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় হাতির দল থেকে বাঁচতে ফসল ও বাড়ি-ঘরের চারপাশে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতায়িত করে। ওই বিদ্যুতায়নের তারে জড়িয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি হাতি মারা পড়ে। সীমান্তে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব যখন চরম পর্যায়ে তখন সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সরকারের কাছে মানববন্ধন করে এর প্রতিকার চায়। সেসময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে উভয়ের সহাবস্থানের বিকল্প নেই। তাই স্থানীয় বন বিভাগ চিন্তা করেন, যেহেতু বন্যহাতি তাদের খাদ্যের সন্ধানে ভারতের ওপার থেকে কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে বাংলাদেশ সীমান্তের এপারে চলে আসে। অনেক সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষিরা তাদের ওখানে হাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সীমান্তের গেইট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হাতির প্রবেশ সহজ করে দেয়। তাই বাংলাদেশের গভীর জঙ্গলে হাতির খাদ্য উপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করা হয়। যাতে ওইসব বৃক্ষ বড় হলে হাতি আর লোকালয়ে না এসে গভীর জঙ্গলেই বসবাস করে। প্রকল্পটি প্রথমে শ্রীবরর্দী উপজেলার হারিয়াকোনা এবং ঝিনাইগাতি উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায় করা হলেও শুরুতেই ক্ষুধার্ত হাতির দল প্রথম দফা ওইসব গাছ সাবাড় করে দেয়। তারপরও ওইসব বাগানে গত এক বছরে বেশ কিছু গাছ বড় হয়ে হাতির খাদ্যের কিছুটা জোগান হয়। ফলে চলতি বছরের শুরু থেকে সীমান্তে হাতির আক্রমণ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কমে গেছে। সর্বশেষ গত দুই বছরে হাতির হামলার শিকারও হয়নি কেউ। তবে বেশ কয়েকটি গ্রামে কিছু ফসলের ক্ষেত বিনষ্ট করে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, প্রায় শতাধিক সদস্যের হাতির দল বর্তমানে শ্রীবরর্দী উপজেলার বালিঝুড়ি রেঞ্জ অফিসের উত্তরে সীমান্ত ঘেঁষা গভীর জঙ্গলে অবস্থান করেছে। যদিও তারা মাঝে মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে সীমান্ত এলাকা বরাবর জেলার সর্ব পূর্বে নালিতাবাড়ি উপজেলার নাঁকুগাও ও পানিহাতা পর্যন্ত চলে আসে। আবার তারা রাতারাতি অন্যত্র চলে যায়। হতির দল সাধারণত ধানের মওসুমে এবং গিষ্মকালের আম-কাঁঠাল খেতে লোকালয়ে নেমে আসে। এবারো অন্যান্য বারের মতো বছরের শুরু থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় লোকালয়ে নেমে আসলেও তারা ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা করছে না। হঠাৎ করেই তারা লোকালয়ে নেমে এসে আবারো চলে যায়। 

এর কারণ হিসেবে জানা যায়, হাতির দল এবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরে গভীর জঙ্গলে সামান্য কিছু খাবার সন্ধান পাওয়ায় তারা আর খুব একটা লোকালয়ের ফসল ও ঘরবাড়িতে হামলা করছে না। তারা সারাদিন-রাত পাহাড়ি জঙ্গলেই অবস্থান করে। তবে জঙ্গলের ভিতর যেসব কৃষক সরকারী জমিতে অবৈধভাবে বিভিন্ন সবজি চাষ করেছে তাদের সবজি ক্ষেত সাবার করে ফেলেছে গত কয়েক দিনে। এতে ওইসব মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে হাতির ওই গভীর জঙ্গলের আশ্রয়ে হামলে পড়ছে। তারা চাচ্ছে হাতির দলকে তাড়িয়ে ভারতে ঠেলে দিবে। একারণে সীমান্তবাসী এখন হাতির খোঁজ পেলেই দল বেঁধে নেমে পড়ছে হাতি তাড়াতে। ফলে হাতির দল এখন মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। যেকোনো সময় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আবারো লোকালয়ে ঢুকে পড়ে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও জানমালেল উপর হামলা করতে পারে বলে সীমান্তের সচেতন মানুষ মনে করছে।

এছাড়া বন্য প্রাণী সংক্রান্ত সচেতন মহল মনে করেন, বনের যেকোনো জীবজন্তু তাদের আবাসস্থলে মানুষের বিচরণ হলে সেখানে তারা বেশি দিন থানে না। সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আবাসস্থল হুমকির সন্মুখিন হলে অনেক শান্ত প্রাণীও হিংস্র হয়ে উঠে। তাই সচেতন মহল মনে করেন, হাতি লোকালয়ে এসে ফসল নষ্ট করলে তাতে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় এটা ঠিক। কিন্তু হাতি নিরিবিলি গভীর জঙ্গলে অবস্থান করলে তখন তাদের কোন ক্ষতি বা ভয় দেখানো উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়ে আবারো সীমান্তে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।

শেরপুরের পরিবেশ বিদ ও বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির সভাপতি সুজয় মালাকার বলেন, আমাদের গারো পাহাড় এলাকায় সম্প্রতি হাতির আশ্রয়স্থল হয়েছে তাদের পূর্ব পুরুষদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে। হাতি বা যেকোনো বন্য প্রাণী তাদের আশ্রয়স্থলে মানুষের বিচরণ হলে বা মানুষ ফসল ও ঘর-বাড়ি নির্মাণ করলে তাতে বন্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়ে। হাতিরা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ সেই গভীর জঙ্গলেই হাতির উপর হামলে পড়ছে। এতে হাতির আশ্রয়স্থল বা বিচরণ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই হাতিও মানুষের আবাসস্থল ও খাদ্যের জন্য ক্ষেত খামারে আক্রমণ চালাচ্ছে। কথায় আছে, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃ কোলে’। তাই আমি মনে করি আমাদের এই অঞ্চলের হাতিকে রক্ষায় তাদের মতো করে থাকতে দেয়া উচিত। বনের ভিতর আমরা যেন তাদের কোনো রকম বিরক্ত না করি এবং সেই সাথে প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হাতি রক্ষায়।

এ বিষয়ে জেলার শ্রীবরদী উপজেলার বালিঝুড়ি রেঞ্জের রেঞ্জার রবিউল ইসলাম বলেন, বন্যহাতি আবাস স্থলে মানুষের হামলা হলে, হাতিও মানুষের আবাসে হামলা করে। ইদানিং হাতি ক্ষেত-খামারে খুব একটা ক্ষতি করছে না। তবে পাহাড়ের সরকারী ফরেস্ট বনের ভিতর সোনাঝুড়ি এলাকায় সম্প্রতি কিছু মানুষ সবজি চাষ করলে হাতি তা সাবার করেছে, তাই সেখানের মানুষ হতির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। আমার লোকবল কম থাকায় আমি সেভাবে হাতি-মানুষের সহাবস্থান করতে পারছি না। তারপরও মানুষের হাত থেকে হাতিকে রক্ষা করতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ অঞ্চলের হাতির অবস্থান হলে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের মতো শেরপুর জেলাও পরিচিত লাভ করবে হাতির অঞ্চল হিসেবে। এতে জেলা ব্র্যান্ডিং ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলশীমালার সুগন্ধে’ এর নামকরণ সার্থক হবে পর্যটকরা হাতি দেখতে শেরপুর আসবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫