
ছবি: সংগৃহীত
সঠিক রোগ নির্ণয় হলে সঠিক চিকিৎসাটি দেওয়া যায়; কিন্তু এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে সেবার নামে চলছে বাণিজ্য এবং মুনাফাখোরি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে কি হয়, তা সাধারণ মানুষের ধারণা না থাকলেও বিভিন্ন সময় এর নানা ফাঁক-ফোকর বেরিয়ে এসেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরকারি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে, কখনো রোগীর লোকেরা নিজেরাই চেষ্টা করে তা ধরছেন আবার কখনো চিকিৎসকদের মাধ্যমেও ধরা পড়ছে।
দেখা যায়, রোগ নির্ণয়ের নামে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতারণা করা হয় নিয়মিত। সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানেরও অভাব নেই। তাদেরও ভুল হয়ে থাকে; কিন্তু তা অনিচ্ছায় এবং তা শুধুই ভুল। তবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আজকাল সেবার নামে নানা ধরনের প্রতারণা চলছে। পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে এক ধরনের প্রতারণা চলছে। এতে অনেক সময় অধিক মুনাফার লোভে কিছু মালিক জড়িত আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু চিকিৎসকের যোগসাজশও পাওয়া যাচ্ছে।
ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কত মুনাফা হয়? : ডায়াগনস্টিকের প্রতিটি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় খরচ কত হয় আর মুনাফা কত, তা নিয়ে গবেষণামূলক কোনো রিপোর্ট না থাকলেও প্যাথলজির সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিলে চমকানো তথ্য। বিভিন্ন রিএজেন্ট (রাসায়নিক উপাদান, যা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়) দিয়ে যেসব পরীক্ষা করা হয় সেগুলোতে ১০ শতাংশ খরচও হয় না। যেমন সবার বোধগম্য একটি উদাহরণ দিয়ে তা বোঝানো যায়। যেমন- ব্লাড গ্রুপিং করলে কত খরচ হয়ে থাকে? একটি ব্লাড গ্রুপিং করতে তিন ফোঁটা রি-এজেন্ট প্রয়োজন হয়ে থাকে। এই তিন ফোঁটা রিএজেন্ট রক্তের ফোঁটায় দিয়ে নাড়াচড়া করলে রক্তের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো পৃথক হয়ে যায় এবং তা দেখেই টেকনোলজিস্টরা বলে দেন কার রক্তের গ্রুপ কী। একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জানিয়েছেন, ব্লাড গ্রুপিংয়ের জন্য মাত্র এক টাকার রিএজেন্ট লাগে; কিন্তু বিভিন্ন প্যাথলজি সেন্টারে ৩০ টাকা থেকে ১০০ টাকা রাখা হয়ে থাকে। এবার এখান থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, যে প্যাথলজি পরীক্ষায় কী ধরনের ব্যবসা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ওই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জানিয়েছেন, যেসব পরীক্ষায় রিএজেন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাতে শুধু পরীক্ষার খরচ ৫ শতাংশের বেশি হয় না; কিন্তু সেই পরীক্ষার ফি-ই নেওয়া হয় কয়েকশ’ টাকা। যেমন কারও মল বা প্রস্রাব অথবা রক্তে কোনো ধরনের জীবাণু রয়েছে কি-না, পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হলে প্যাথলজি সেন্টারের দুইশ’ অথবা তিনশ’ টাকা ফি লাগলেও, সেখানে শুধু পরীক্ষা খরচ পাঁচ থেকে ১০ টাকার বেশি লাগে না। এর সঙ্গে যোগ হয়ে থাকে অবকাঠামো ব্যয়, যে পরীক্ষা করেছেন তার ব্যয় ইত্যাদি। এভাবে সবার ব্যয় ধরার পরও সেই পরীক্ষাটির জন্য খরচ ২৫ শতাংশের বেশি হয় না; কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ১০০ শতাংশের বেশি ফি রাখা হয়ে থাকে।
বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে পরীক্ষা নিয়ে নানা বাণিজ্য : বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি সেন্টারগুলোতে বাণিজ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব সেন্টার যেন টাকা বানানোর মেশিন। মৃত্যু পথযাত্রী রোগীটাকে নিয়েও চিকিৎসার নামে চলে অমানবিক কাজ। এ ছাড়া ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা থেকে চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য, রোগী ভর্তিতে দালালদের কমিশন, কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লেখা, অপারেশন নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আইসিইউ অথবা লাইফ সাপোর্টে পাঠানো, কেবিনে রোগী ধরে রাখাসহ লাশ হস্তান্তর পর্যায়ের নানা ধাপে কমিশন লেনদেন হয়। এসব কারণে রোগীকে অথবা রোগীর স্বজনদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর নিয়ম লঙ্ঘন করেই কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো অবাধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সব বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকে এসব হয় না। বাংলাদেশে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার সত্যিই চেষ্টা করে জণকল্যাণে কাজ করতে; কিন্তু অসংখ্য মুনাফাখোরদের ভিড়ে এদের জনকল্যাণ চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নানা পরীক্ষায় ২৫ শতাংশ ছাড় দিয়ে থাকে। আবার চিকিৎসকদের সুপারিশ থাকলে আরও ছাড়ও দেওয়া হয়। তাদের এসব কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অতি মুনাফাখোরদের কর্মকাণ্ডে।
সরকারি অনুমোদন ছাড়াই প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি : সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি এখন। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে টেকনোলজিস্ট দিয়েই চলে সব পরীক্ষা। পরীক্ষা না করে নিজেদের মতো করে রিপোর্ট তৈরি করার অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। একই রোগের পরীক্ষায় কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ভিন্ন রকম রিপোর্ট পাওয়ার নজির রয়েছে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে নারীজনিত রোগের বিবরণ পাওয়া গেছে এমন নজিরও আছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। রোগী বা তাদের অভিভাবকরা নিজের মতো করে পরীক্ষা করালে, সে রিপোর্ট অনেক সময় ডাক্তাররা গ্রহণ করেন না। নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে রোগীকে চাপ দেন। কারণ তিনি সেটার কমিশন পাবেন। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন ফি নির্ধারণ করা আছে। বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি’র তালিকা প্রতিষ্ঠানের এমন স্থানে লাগিয়ে রাখার নির্দেশ রয়েছে, যেখানে সবাই দেখতে পারে; কিন্তু এসব নিয়ম মানছে না কেউ। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। রোগী আকর্ষণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় বিশেষজ্ঞদের তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও, তাদের অধিকাংশকেই পাওয়া যায় না। নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেওয়া হয় ওইসব ডাক্তারকে। ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠান্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে থাকেন। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি করানোরও অভিযোগ রয়েছে। সুযোগ থাকলে অপারেশনের করিয়ে লাইফ সাপোর্টেও পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৫০ ভাগ ভর্তি ফি সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে যায়। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ : মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। সাধারণ অপারেশন, ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের ফিজিওথেরাপি, কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রেও আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানারকম সুযোগ-সুবিধাও নিয়ে থাকেন অনেক চিকিৎসক। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নামমাত্র ব্লাড ল্যাব, প্যাথলজি ল্যাব, মানসম্পন্ন ওটি রুম না থাকা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকা, লোকবল না থাকা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা, মেয়াদাত্তীর্ণ ওষুধের ব্যবহারসহ রোগী চিকিৎসার নামে প্রতারণা হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা খেয়েও আবারও একই রকমের প্রতারণা করে যাচ্ছে। রিজেন্ট নামক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মিরপুর শাখাসহ তিনটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে একদিনেই ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করার রেকর্ড রয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের। সেখানে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য যে রাসায়নিক উপাদান ব্যাবহার করা হয়, তার অধিকাংশই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। কর্মচারীরাও পরীক্ষার প্রতিবেদন ফরমে স্বাক্ষর করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েকজন ডাক্তারের স্বাক্ষর এক চিকিৎসক করেছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি রক্ত পরিসঞ্চালনে তারা নিয়ম মানছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার অনুমতিও থাকে না। আবার রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে যেসব রেকর্ড রাখার কথা তা থাকে না। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত বেচাকেনা করা হয়ে থাকে। অথচ রক্ত কেনাবেচার আগে হেপাটাইটিস, এইচআইভি, সিফিলিসসহ ৫টি ভাইরাস রয়েছে কি-না, তা দেখার নিয়ম থাকলেও তা করা হয় না। এসব পরীক্ষা ছাড়াই তারা মাসের পর মাস অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা করে আসছে। রিজেন্ট নামক যে অবৈধ হাসপাতালটি ছিল এদের ওষুধ বিক্রি কেন্দ্রে ৬০ টাকার ওষুধ ৫০০ টাকায় বিক্রি করার প্রমাণ পেয়েছেন র্যাবের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। আবার অনুমোদনহীন বিদেশি ওষুধ পাওয়া যায়, বিশেষ করে ভারতীয় ওষুধ। প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি, সঠিক রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা থেকে রোগীদের রক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে একটি ‘ভিজিলেন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে; কিন্তু তাদেরও গাফিলতির নজির রয়েছে। তারা নিয়মিত পরিদর্শনে যান না।