সংকটে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাশরুম উৎপাদন কেন্দ্র

প্রান্ত রনি
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:৩৩

রাঙামাটির দ্বিতীয় বৃহত্তম মাশরুম বীজ উৎপাদন কেন্দ্র
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে চলছে রাঙামাটির দ্বিতীয় বৃহত্তম মাশরুম বীজ উৎপাদন কেন্দ্র। এখানকার মাশরুম চাষিরা ভালো নেই। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকেই। মাশরুম বীজ প্রাপ্তিতে সংকট, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট নামে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন চাষিরা। এ ছাড়াও পুরনো জরাজীর্ণ ভবনে চলছে স্পন (বীজ) তৈরির কার্যক্রম আর বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই প্রায় অকেজো। সক্ষমতার অনেক কম স্পন উৎপাদন করে কোনোভাবে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এই মাশরুম বীজ উৎপাদন কেন্দ্রের বীজের ওপর নির্ভর করেই ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন স্থানীয় চাষিরা; কিন্তু সময় মতো পর্যাপ্ত বীজ না পাওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছেন তারা। তবে প্রকল্পটি পুনরায় চালু হলে এই সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কর্তৃপক্ষ।
তবে চাষিরা অভিযোগ করেছেন, আমরা পর্যাপ্ত বীজ পাচ্ছি না। আবার বীজ পেলেও সময়মতো পাচ্ছি না। যে কারণে সঠিক সময়ে উৎপাদনেও যেতে পারছি না। তাই বাজারে মাশরুমের চাহিদা থাকলেও, বীজ সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের অনেক মাশরুম চাষি বীজ না পাওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে বেকার জীবনযাপন করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মাশরুম উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের অধীনে এর চাষকে জনপ্রিয় করা এবং স্থানীয়দের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে রাঙামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি এলাকায় প্রায় দেড় একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয় জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র। এখান থেকে উৎপাদিত বীজ কিনে চাষিরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাশরুম চাষ করে থাকেন। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ২০১৮ সালে দুই লাখ টাকার রিভলভিং ফান্ডের মাধ্যমে বীজ উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি; কিন্তু ২০০৯ সালে মাশরুম উৎপাদন কেন্দ্রটি শুরু হওয়ার পর এখানে দৈনিক দুই হাজার পিস বীজ উৎপাদন করা হলেও, বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ১৫০-২০০ বীজ। ফলে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল উৎপাদন না হওয়ায় স্থানীয় চাষিদের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
মাশরুম উৎপাদন কেন্দ্রটি সরেজমিনে দেখা যায়, স্পন (বীজ) তৈরির কারখানার প্রায় সম্পূর্ণভাবে সিলিং ভেঙে পড়েছে। ল্যাব ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন আসবাবপত্র। ভেঙে পড়া সিলিংয়ের একপাশে স্পন তৈরির কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে- অফিস, আবাসিক ভবন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। স্থানীয়রা জানায়, রাত হলে এই উৎপাদন কেন্দ্রটি হয়ে উঠে স্থানীয় মাদকসেবীদের আড্ডাস্থল।
উৎপাদনকেন্দ্রে কর্মরত কয়েকজন শ্রমিক জানিয়েছেন, শুরুর দিকে চাহিদা অনুযায়ী দিনে ৩-৪ হাজার বীজ উৎপাদন করেছি আমরা; কিন্তু এখন ১৫০-২০০ বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। স্থানীয় চাষিদের চাহিদা থাকলেও আমরা পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করতে সক্ষম নই। এ দিকে মাশরুম চাষি কল্পনা চাকমা জানান, বীজ সংকটের কারণে উৎপাদনে যেতে পারছি না। আমরা মাশরুম চাষ ছাড়া আর অন্যকিছু করি না। মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে তারা। আমাদের কথা শোনার কেউ নেই।
আরেক চাষি বিফু পালিত জানান, এই উৎপাদন কেন্দ্রে আমরা পর্যাপ্ত বীজ পাচ্ছি না। ফলে বীজ ঢাকার মাশরুম সেন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হয়; কিন্ত ঢাকা থেকে বীজ আনতে আমাদের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এই উৎপাদন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত বীজের ব্যবস্থার পাশাপাশি যদি আগের মতো স্থানীয় চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সচল থাকত, তাহলে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো।
উৎপাদন কেন্দ্রের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি শেষ হলেও কোনো মতে পুরনো যন্ত্রপাতির সাহায্যে জোড়াতালি দিয়ে আমরা সীমিত আকারে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে চাষিদের প্রচুর মাশরুম বীজের চাহিদা রয়েছে; কিন্তু আমরা আর্থিক সংকটের কারণে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছি না। এখন রিভলভিং ফান্ডের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছি। যদি প্রকল্প পুনরায় চালু হয় তবে এই সংকট থাকবে না।
তবে আশার কথা জানিয়ে জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন সম্প্রসারণ রাঙামাটি উপকেন্দ্রের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মেজবাহ উদ্দিন জানান, বর্তমানে এই মাশরুম উৎপাদন কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন দুইশ’ বীজ উৎপাদন হচ্ছে; কিন্তু স্থনীয়ভাবে কৃষকের কাছে এই বীজের চাহিদা অনেক বেশি। ইতিমধ্যে আমি একটি প্রাক্কলন তৈরি করেছি। সেটি সাভারের কেন্দ্রীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। যদি প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে তাহলে আমরা মাশরুম চাষিদের আবারও কাঙ্ক্ষিত বীজ সরবরাহ করতে পারব।
বাংলাদেশে মাশরুম চাষে প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ নেওয়া চাষি ও আদর্শ মান্না মাশুরুমের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী শিপু বলেন, মাশরুম চাষের সবচেয়ে বড় সমস্যা সমন্বয়হীনতা। সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় মাশুরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ মাশুরুম ফাউন্ডেশনের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। দেশের বৃহত্তম মাশরুম বীজ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্পটি আবার চালু করা উচিত। আমাদের দেশে মাশরুমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে না পারলে শিল্পটির টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়বে।