ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ঐতিহ্য রক্ষায় কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি

রফিক মজিদ, শেরপুর
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৪৩

শেরপুর জেলার মানচিত্র
দেশের উত্তরাঞ্চলে গারো পাহাড় হিসেবে খ্যাত শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা ভারতের মেঘালয় সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আর এখানকার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি বনে সুদীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছেন- গারো, কোচ, হাজং, ডালু, বানাই ও হাদি সম্প্রদায়ের লোকজন। এক সময় তারা বছরজুড়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তাদের ছিল একটা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সময়ের আবর্তে শেরপুরের এ সম্প্রদায়সমূহের সংস্কৃতি, ভাষাসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সংগঠন ট্রাইভাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (টিডব্লিউএ) সূত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১১টি ইউনিয়নে ৭৪টি গ্রামে সহস্রাধিক পরিবারে প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে বাপ-দাদার বসতভিটায় বসবাস করে আসছেন। এসব মানুষ পাহাড়ে শাল ও গজারির বনে ছোট ছোট ঝুপড়িতে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে আজও টিকে আছে নানা কষ্টে। এদের অধিকাংশ পরিবারই পাহাড়ি বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ আর অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব সম্প্রদায়ের রয়েছে আলাদা আলাদা কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা। গারোরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর কোচ ও হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
রাংটিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গারো বাপ্পি ম্রং জানান, গারোদের স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষার নাম ‘আচ্ছিক কাথ্যা’। আচ্ছিক বলতে বোঝায় গারো যারা পাহাড়ে বাস করে, আর কাথ্যা শব্দের অর্থ ভাষা। গারোরা প্রধানত পাহাড়ে বসবাস করে এবং তাই আচ্ছিক কাথ্যার মানে গারোদের ভাষা। এটা গারোদের মৌখিক ভাষা এবং তারা এখনো লিখিত ভাষার উদ্ভব ঘটাতে পারেনি।
সীমান্তঘেঁষা খলচান্দা গ্রামের মিঠুন কোচ বলেন, আমরা বন-পাহাড়ে যুদ্ধ করে অসহায় জীবনযাপন করে আসছি। তাই পেটের তাগিদে অভাবের তাড়নায় ইতিহাস-ঐতিহ্য কিছু বুঝি না; শুধু এটাই বুঝি বেঁচে থাকতে হবে। নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে কোচ ভাষা আর গারোদের আছে আচিক ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ হয়েছে।
নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের তথা মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের নিজস্ব ভাষায় স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান খলচান্দা গ্রামের শ্রী অনিল কোচ (৩৪)। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলাজুড়ে দিয়ে কথা বলেন। তাই আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোচদের ভাষাও আজ বিলুপ্তির পথে।
বর্ণমালা তথা লেখ্যরূপের অভাবে গারো সম্প্রদায়ের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। মান্দি (গারো) সমাজের বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাস, অতীতে আচিক ভাষার বর্ণমালা তথা লেখ্যরূপ ছিল; কিন্তু বর্তমানে আধুনিক জীবনযাপন ও সুষ্ঠুচর্চা না থাকায় গারোদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
একইভাবে কোচদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো- দুর্গাপূজা, কালিপূজা ও সরস্বতী পূজা। এসব ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও কোচরা আলাদা আলাদা নিজস্ব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। সুষ্ঠু চর্চা ও আধুনিক যুগের তাল মেলাতে গিয়ে এসব হাজং ও কোচদের শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
ট্রাইভাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডাব্লিউএ) শ্রীবরদী উপজেলার চেয়ারম্যান প্রঞ্জল এম সাংমা বলেন, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণে শেরপুরের বিভিন্ন উপজেলায় কালচারাল একাডেমি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানায়, যা তাদের বিলুপ্ত হতে যাওয়া বিভিন্ন উপকরণ স্মৃতি স্বরূপ যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত থাকবে।