Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

২০২১ সালে সড়কে প্রাণহানিতে রেকর্ড

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:১৭

২০২১ সালে সড়কে প্রাণহানিতে রেকর্ড

ফাইল ছবি

গতিসর্বস্ব উন্নয়নের নজির উন্নত সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি। আর এই উন্নয়নের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণাম’ ক্রমবর্ধমাণ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণ। এ নিয়ে নানা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট উদ্বেগের। ট্রাফিক আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের ঢিলেঢালা ভাব ও ঘুষবাণিজ্যের কারণে গাড়িচালকদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে।

মহাসড়কেও দেখা যায়, সব নিয়ম ভেঙে চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন উল্টো পথে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ঝুঁকিপূর্ণ যান চালানোর কারণেই ঘটে প্রায় ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা। তার সঙ্গে আছে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা ও চালকদের অসতর্কতা।

দিন যায় বাড়ে দুর্ঘটনা : বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সড়কে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৩৭০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আহত হয়েছেন মোট ৭০ হাজার ২২২ জন। পুরো বছরে সড়কপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৫১২টি। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি টাকা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য রোডের তথ্য এমনটাই বলছে। এর মধ্যে বছরের শুরু জানুয়ারিতে সারাদেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৪৮৪; ফেব্রুয়ারিতে ৪০৬টিতে ৫১৭; মার্চে ৪০৯টিতে ৫১৩ জন। করোনার কারণে এপ্রিলের বিধিনিষেধ চলাকালেও দেশে ৪৩২টি ঘটনায় ৪৬৮; মে’তে ৪৪১টি ঘটনায় ৫৬২; জুনে ৩২৭টি ঘটনায় ৩৯৮ জন; জুলাইয়ে ২৯৩টি ঘটনায় ৩৫৬; আগস্টে ৩০২টি ঘটনায় ৩৭৯; সেপ্টেম্বরে ৩৬২টি ঘটনায় ৪৩৯; অক্টোবরে ৩৪৬টি ঘটনায় ৪০৭; নভেম্বরে প্রাণ হারান ৪১৩ জন, যেখানে ৫৪ জনই শিক্ষার্থী। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেও সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সমান তালে।

নিহতদের তালিকায় আছেন- পুলিশ, সেনা, বিমানবাহিনী ও এপিবিএনের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, সাংবাদিক, হাসপাতালের পরিচালক, পল্লী চিকিৎসক, নার্স, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার, পশুসম্পদ কর্মকর্তা, ভূমি কর্মকর্তা, নির্বাচন অফিসের কর্মচারী, জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, ইমাম, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- অতিরিক্ত গতি, ভুল ওভারটেকিংসহ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সড়কে থামিয়ে দিচ্ছে জীবনের গতি। দুর্ঘটনারোধে গাড়ি চালানোয় দক্ষতার অভাব দীর্ঘ দিনের আলোচিত বিষয়। তবুও বৈধ চালকের চেয়ে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। সার্বিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না পরিবহন খাত। আর পুলিশের তথ্য বলছে, দেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। এর বাইরে ভুল ওভারটেকিংয়ে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ আর অন্যান্য কারণে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। 

সড়কের ধরনভিত্তিক দুর্ঘটনার হার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ৭০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে। এর বাইরে আঞ্চলিক সড়কে ১৮ দশমিক ৪, গ্রামীণ রাস্তায় ৫ দশমিক ৪, সংযোগ সড়কে ৪ দশমিক ২ ও শহরের রাস্তায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। অন্য একটি গবেষণা বলছে, সবচেয়ে বেশি ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা হয় অনিয়ন্ত্রিত এলাকায়। আর ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ১৩ দশমিক ৮, রোড ডিভাইডার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৮ দশমিক ২, পথচারী পারাপারে ২ দশমিক ৩, পুলিশ ও ট্রাফিক বাতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার ১ শতাংশ।

সড়ক ব্যবস্থাপনাকে লালকার্ড : বছরের শেষের দিকে উত্তাপ ছড়ায় শিক্ষার্থীরা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর গণপরিবহনের লাগামহীন ভাড়া বাড়লে শুরু হয় প্রতিবাদ। রাজধানীর একটি ছাত্রী বাড়তি ভাড়া না দিতে চাইলে তাকে ধর্ষণের হুমকি দেয় বাসচালক ও সহকারী। সে খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ ও অবরোধে উত্তাল হয় রাজপথ। এক সময় তা রূপ নেয় হাফ ভাড়া ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে। সেই আগুনে ঘি ঢালে সড়কে নটর ডেমের ছাত্র নাঈম হাসান ও স্কুলছাত্র মাঈনুদ্দিন ইসলামের প্রাণ হারানোর ঘটনা।

চালকের লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয় শিক্ষার্থীরা। কাগজ ঠিকঠাক না থাকায় বেশ কিছু যানবাহন আটকে জরিমানা ও মামলা করতেও বাধ্য করে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের গাড়ি ছিল। শুধু তাই নয়, বিশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থাপনাকে লাল কার্ডও দেখায় তারা। তাদের দাবি, সড়কে একের পর এক মৃত্যুর জন্য পুরো সিস্টেম দায়ী; যে সিস্টেমের মধ্যে ঘুষ আছে, যে সিস্টেমের মধ্যে আছে লুটপাট। সেই সিস্টেমকেই লাল কার্ড দেখায় শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে দফায় দফায় বৈঠকে বসে বিআরটিএ আর বাস মালিক সমিতি। শর্তসাপেক্ষে মেনে নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবি। দেশের সব মহানগরে বেসরকারি বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নির্ধারণ করে গত ১২ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

তবে গবেষকরা বলছেন, হাফ ভাড়ার প্রজ্ঞাপন দিয়ে আন্দোলন ঠান্ডা করতে পারলেও সমস্যা কিন্তু থেকেই গেছে। কেননা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে হাত দিতে হবে সমস্যার মূলে। পুরো দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। পরিবহন খাতকে করতে হবে চাঁদাবাজমুক্ত, ফেরাতে হবে শৃঙ্খলা। 

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন পর্যাপ্ত জনবল। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও দেশের প্রতিটি সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। লাইসেন্স না থাকা কোনো চালককেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে দুর্ঘটনারোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। চালক থেকে শুরু করে যাত্রী, মালিক কিংবা সংশ্লিষ্ট সংস্থা- কাজ করতে হবে সবাই মিলে।

বৈধ গাড়ির অবৈধ চালক : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪২০টি। ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ৪২ লাখ ৪৩ হাজার ৯০২ জনের, আর ২ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ যানবাহনের কোনো বৈধ চালক নেই। নিবন্ধিত ভারী গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৪টি, এর বিপরীতে লাইসেন্স রয়েছে কেবল ১ লাখ ৫ হাজার ৭৪৬ জনের। অর্থাৎ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৮টি গাড়ি পরিচালিত হচ্ছে ভিন্ন ক্যাটাগরির লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিংবা অবৈধ চালক দিয়ে। এ ছাড়া ৩০ লাখ ৬২ হাজার ৫৩৪টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত থাকলেও লাইসেন্স রয়েছে ১৬ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৬ জনের। বাকি ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ১২৮টি মোটরসাইকেলের কোনো বৈধ চালক নেই।

এই অসঙ্গতির বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ‘সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। বৈধ চালকের পরিসংখ্যান জেনেও নতুন গাড়িকে ছাড়পত্র দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংকট সমাধানে গড়ে তোলা হচ্ছে না দক্ষ চালক। তাই এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে নিবির নজরদারি ও আইন প্রয়োগের বিষয়ে।’ 

বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী অবশ্য বলছেন, ‘জটিলতা কমিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে ভিন্ন ক্যাটাগরির লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়ে নতুন বিধিমালায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে লাইসেন্স বরাদ্দজনিত সমস্যা সমাধানে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই হাতে লাইসেন্স পাবেন প্রকৃত চালকরা।’

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে দায় নিতে নারাজ পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাহজাহান খান বলেন, চালকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না দিয়েই আমরা বলি, বেপরোয়া গতির গাড়ির জন্য দুর্ঘটনা হয়। এ জন্য ড্রাইভার দায়ী। আমি অস্বীকার করব না যে, ড্রাইভাররা বেপরোয়া গাড়ি চালায় না; কিন্তু এ জন্য ড্রাইভারদের এককভাবে দায়ী করা যাবে না। ড্রাইভারদের ট্রেনিংসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। তবে এমন যদি কেউ মনে করে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে, সেটা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নাই যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নেই। সর্বনিম্ন দুর্ঘটনার দেশগুলোতেও বছরে দুই থেকে আড়াই শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।’ 

বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার দায় কারও একার নয়। বছরের পর বছর বিআরটিএ কয়েক লাখ লাইসেন্স দিতে পারছে না। ফলে বাড়ছে চালক সংকট। সড়ক দুর্ঘটনারোধে দক্ষ চালক তৈরির বিকল্প নেই; কিন্তু করোনায় থমকে গেছে সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫