-copy-61fe3ba0df125.jpg)
ক্যাডেট কলেজ ক্লাব
ভারতবর্ষ তার দীর্ঘকালীন মধ্যযুগীয় খোলস পাল্টে ইংরেজদের স্পর্শেই নতুন করে জেগে ওঠার মন্ত্র খুঁজে পায়। পরিচিত হয় ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সঙ্গে। ভারতবাসীর সামনে খুলে যায় এক নতুন আকাশ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতিচারণ করেন, ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ চরিত্রে। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম।’ যদিও ক্রমে বণিকের মানদণ্ড পরিণত হয় শাসকের রাজদণ্ডে। যেখানে গেছে সেখানেই গড়েছে ‘সাহেবী ক্লাব’। পোক্ত করেছে নিজেদের বন্ধন। ভারতবর্ষে প্রথম অভিজাত ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেই, ‘ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাব’। ১৭৯৩ সালে যার গোড়াপত্তন। এরপর একে একে গড়ে ওঠে ব্যাঙ্গল ক্লাব (১৮২৯), ক্যালকাটা পলো ক্লাব (১৮৬২), সেটারডে ক্লাব (১৮৭৫), চিটাগাং ক্লাব (১৮৭৮), খুলনা ক্লাব (১৮৮৫), সিলেট স্টেশন ক্লাব (১৮৮৬), রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব (১৮৮৮), টলিগঞ্জ ক্লাব (১৮৯৫) ও ক্যালকাটা ক্লাব (১৯০৭)। অবশ্য লেখক ও সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার তার একটি লেখায় উল্লেখ করেন- বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ববঙ্গ) প্রথম ক্লাব গড়া হয় বরিশালে, ১৮৬৪ সালে। কেবল ইংরেজদের ব্যবহারের জন্য এর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি ক্লাব গড়া হয়; কিন্তু জ্ঞানের অগ্রদূত হয়ে যারা ভারতবর্ষে এসেছিল, অচিরেই দেখা দিল তাদের বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ। মত্ত হয় মানবতা লঙ্ঘনের খেলায়।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নিজের আত্মীয় হিসেবে গ্রহণের বুলি আওড়ালেও তাদের ছিল জাতিগত সংকীর্ণতা। তাই অভিজাত হলেও, ক্লাবগুলোর সদস্য হওয়ার সুযোগ দিত না বাঙালিদের। এমনকি ফটকে লেখা থাকত- ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর নট অ্যালাউড’, অর্থাৎ কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। তাদের এমন চরিত্র-পরিবর্তন দেখে নিজের ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে সেই রবীন্দ্রনাথেরই আক্ষেপ, ‘ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয় মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্য নয়, আগুন লাগাবার জন্যে।’ তিনি এও লেখেন, ‘প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’
যুগ পাল্টেছে। ইংরেজদের গড়া সেই অভিজাত ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ এসেছে বাঙালিদের হাতে। কাজ আর সংসারের বাইরে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটু অবসর সময় কাটানোর জন্য এর জনপ্রিয়তা আর পরিচিতি বেড়েই চলেছে। তাই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি ক্লাব। পারস্পরিক পরিচয়, যোগাযোগ এবং সম্পর্কের আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব গড়ার লক্ষ্য নিয়েই এর পথচলা। নিজেদের বিনোদনের পাশাপাশি আছে সামাজিক দায়বদ্ধতাও। ক্রান্তিকালে তাই দাঁড়াচ্ছে হতদরিদ্র কিংবা প্রতিবন্ধীদের পাশে। ক্লাবগুলোতে কর্মসংস্থানও হচ্ছে অনেক যুবকের। যদিও লাইসেন্স নিয়ে গজাচ্ছে নিত্যনতুন অনেক ক্লাব। বিক্রি করছে চড়া দামে সদস্য পদ। টাকা হলেই যে কেউ ‘ভূঁইফোড়’ এসব ক্লাবে নাম লেখাতে পারছেন। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়েও রয়েছে রাজ্যের প্রশ্ন। কোনো কোনোটিতে আছে রাতভর জুয়া, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলার অভিযোগ। সঙ্গত কারণেই ক্লাবের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরূপ ধারণা; কিন্তু এসবের ঊর্ধ্বে থেকেই যুগের পর যুগ ধরে নিজের আভিজাত্য নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো।
স্বমহিমায় উজ্জ্বল ঢাকা ক্লাব
ঢাকা ক্লাব। যার উচ্চারণের সঙ্গে বনেদিয়ানা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঝকঝকে মেঝে থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত কাঠের নিপুণ কারুকাজ। ভেতরের আধুনিক আসবাব আর আলোকসজ্জা। যে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলকেই টেক্কা দেবে। বিনোদনের জন্য রয়েছে চমৎকার ব্যবস্থা। হেলথ ক্লাবে নিয়মিত শরীরচর্চার সুযোগ, গানের স্কুল, নাচের স্কুল, ছবি আঁকার স্কুল, সাঁতার শেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রায় ১০ হাজার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও আছে ক্লাবটির। বইয়ের পৃথিবীতে ডুব দিয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ক্লাবটিতে প্রবেশাধিকার শুধু সদস্যদের মধ্যেই সংরক্ষিত। এর সদস্য হওয়াও কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য চাই যথেষ্ট শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ মন এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। অত যোগ্যতা অর্জন করে যে ক্লাবের সদস্য হতে হয়, ওই ক্লাব তো আর সবার জন্য খুলে দেওয়া যায় না। তাই বলে ঢাকা ক্লাবের চৌকাঠ মাড়ানো একেবারে অসাধ্যও নয়। যে কোনো সদস্যের সঙ্গে অতিথি হয়ে ভেতর ঢোকা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্লাবের ড্রেস কোডটি মাথায় রাখতে হবে। কলার ছাড়া গেঞ্জি পরে কিংবা হাওয়াই চপ্পল পায়ে গলিয়ে অথবা ঘরে পরার পোশাকে কেউ ঢুকতে গেলে মূল ফটকেই আটকে দেওয়া হবে, সদস্য কিংবা অতিথি- সে যেই হোক।
ঢাকা ক্লাবকে আজকের এই অবস্থানে আসতে বছর কিংবা যুগ নয়, পেরুতে হয়েছে শতাব্দী। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে আসাম ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। পদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা এখানে আসতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে বাড়ে দেশি-বিদেশি বণিকদের পদচারণাও; কিন্তু ঢাকার শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী ও নাগরিকদের জন্য সামাজিকতা ও অবসর বিনোদনের জায়গা তখনো গড়ে ওঠেনি। এক রকম বাধ্য হয়েই ঢাকা ক্লাব গঠন করে ইংরেজরা। বাংলা-আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট একটি শ্বেত পাথরের ফলকের ওপর থেকে পর্দা তুলে উদ্বোধন করেন ক্লাবের। যদিও এর আইনগত ভিত্তি স্থাপিত হয় আরও কয়েক মাস পরে, ১৪ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় কোম্পানি আইন-১৮৮২ অনুযায়ী দেওয়া হয় সেই মর্যাদা। অবশ্য প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ অনুসারে, ক্লাবটির যাত্রা শুরু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন পুরন ঢাকার আন্টাঘর ময়দানের (বাহাদুর শাহ পার্ক) একটি কোণায় আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড খেলার ক্লাব অবস্থিত ছিল। পরে ইংরেজরা এটি কিনে নিয়ে ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে সেটি ছিল ১৮৫১ সাল। পরবর্তীতে ঢাকার নবাব জমি দিলে ১৯১৩ সালে বর্তমান ভবনটিতে চলে আসে ক্লাবটি।
১৯৪১ সালে রমনা এলাকার যেটুকু নবাবদের কাছে ছিল সরকার তা নিয়ে নেয় এবং তারপর ঢাকা ক্লাবকে ইজারা দেয় ৫২৪ বিঘা জমি। এর মধ্যে ঘোড়দৌড় খেলার রেসকোর্স ছিল ২৯০ বিঘা, গলফ কোর্স ২১৯ বিঘা এবং বাকি ১৫ বিঘা ছিল ক্লাব ভবন ও চত্বর। বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বারডেম হাসপাতাল, বেতার ভবন ঢাকা ক্লাবের সেই জায়গার ওপরই গড়ে উঠেছে। সেই রেসকোর্স ও গলফ খেলার মাঠটিও নাম পাল্টে হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কেবল ৫ একর বা সাড়ে ১২ বিঘা জমি। তবে এ জায়গাতেই সভাকক্ষ, সেমিনার কক্ষ, হল ঘর, অতিথি কক্ষ, রান্নাঘর ও খাবার ঘর এবং টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, সাঁতার, লন টেনিস ইত্যাদি খেলার সুবিধা রাখা হয়েছে।
আজীবন ও বিশেষ সদস্য মিলিয়ে ঢাকা ক্লাবের সদস্য তিন হাজারেরও বেশি। শহরের অভিজাত শ্রেণির লোকেরা প্রাণখোলা আড্ডার লোভেই এখানে এসে হাজির হন। আর সেই আড্ডা থেকেই বেরিয়ে আসে অনেক ভালো কাজের পরিকল্পনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, পুনর্বাসন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য বিশাল অঙ্কের অনুদানের ব্যবস্থাও করেছেন ঢাকা ক্লাবের সদস্যরা। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও শীতার্ত ব্যক্তিদের পাশে সব সময়ই তাদের পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানও পালন করছে ঢাকা ক্লাব। পয়লা বৈশাখ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নজরুল-রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রভৃতি দেশীয় সংস্কৃতির চর্চাও হচ্ছে ব্রিটিশদের হাতে গড়া ক্লাবটিতে।
তবুও ঢাকা ক্লাবকে ঘিরে মানুষের কানাঘুষা কি কমেছে? সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল পরপর তিনবার ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সাদাত সেলিমের কাছ থেকে, ‘সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ক্লাবের যে বিচ্ছিন্নতা, সেটা আমরা দূর করার চেষ্টা করছি। মানুষ যাতে ঢাকা ক্লাব সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পুষে না রাখে। এ জন্য আমরা নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছি। আমি মনে করি, বিচ্ছিন্নতার সেই প্রাচীরটা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে।’ নানা ঘটনা ও বিভিন্ন অভিযোগের যুক্তি খণ্ডিয়ে ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বলেন, ‘ক্লাবগুলোতে মূলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্পোর্টস হয়। এর সঙ্গে কিছু রিফ্রেশমেন্ট থাকে। ক্লাবের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। এর কোনো ব্যত্যয় হয় না। আর সেই নিয়ম মেনেই সদস্য করা হয়। অর্থ-বিত্ত থাকলেই কেউ ক্লাবের মেম্বার হয়ে যেতে পারেন না, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য গুণাবলি থাকতে হবে।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেন, ‘নিউ জেনারেশন ক্লাবগুলোতে নতুন আঙ্গিক বা কিছু নতুনমাত্রা হয়তো যোগ হতে পারে; কিন্তু বেসিক যে কোড অব কন্ডাক্ট, এটা প্রায় সব প্রসিদ্ধ ক্লাবেই এক থাকে। আর এগুলো মেনে চলতে হয় সদস্যদের। কেউ ব্যত্যয় ঘটালে ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাকে শোকজ করে। এমকি গুরুতর অভিযোগে স্থায়ী বহিষ্কারও করা হয়।’
সেকালে ‘ইউরোপিয়ান’ একালে ‘নারায়ণগঞ্জ ক্লাব’
শীতলক্ষ্যার তীরের জনপদ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। এখান থেকে ‘সোনালি আঁশ’খ্যাত পাট পাঠানো হতো কলকাতায়। ব্যবসার জন্য ১৮৮৩ সালের দিকে শীতলক্ষ্যায় ভেসে ব্রিটিশরাও আসা শুরু করে; কিন্তু অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য সেখানে কোনোকিছু না থাকায় ২০ জন বিনোদন-পিপাসু শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ ১৮৯৩ সালে গড়েন ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব’। তবে ক্লাব হলেও প্রতি রবিবার সকালে থাকত প্রার্থনা, চার্চের মতো। আর সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা; মাঝে মধ্যে নৃত্য উৎসবেরও আয়োজন বসতো মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে আসা ব্রিটিশ বাবুদের মনোরঞ্জনে। ক্লাবের কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ১৯০৫ সালে লাউঞ্জ এবং কার্ড রুম স্থাপিত হয়। সদস্য সংখ্যা বাড়ে এবং বিনোদনমুখী অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার জন্য ক্লাবের প্রাঙ্গণে একটি আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয়। দ্রুতই এটি নাটকের মহড়া ও মঞ্চায়নের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তবে কেবল গান ও নৃত্য পরিবেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না ক্লাব, শারীরিক সুস্থতার জন্য ছিল বিভিন্ন খেলাধুলার ব্যবস্থাও। ফুটবল, বিলিয়ার্ড, লন টেনিস, ব্রিজ, স্কোয়াশ ও রাগবির আয়োজন করা হতো। এ ছাড়া ক্লাবের তত্ত্বাবধানে শুরু থেকেই জিমখানা মাঠে গলফ এবং রাইফেলস ক্লাবে শুটিংয়ের আয়োজন করা হয়।
নারায়ণগঞ্জবাসীর কৌতূহলের এই ক্লাবটি ঘিরেই যেন ব্রিটিশ নাগরিকদের সব আভিজাত্য। যথারীতি ইংরেজরা ছাড়া অন্যদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি প্রথম দিকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশের লোকদেরও সদস্যপদ দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছু অস্ট্রেলিয়ান এবং আমেরিকান ছাড়া উপ-মহাদেশের কোনো বিখ্যাত ও বিত্তশালী ব্যক্তিকেও সদস্য করা হয়নি। আর্মেনিয়ান বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাও ক্লাবের সদস্য হতে পারেননি। কালের পরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নাম পাল্টে ব্রিটিশদের ইউরোপিয়ান ক্লাব হয়ে ‘নারায়ণগঞ্জ ক্লাব’। স্থানীয় কয়েকজন সদস্য হন। বাঙালিদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন কাজী আজহার হোসেন, কে রশিদ, ফুটবলার জুনিয়র এম এ রশিদ, কবির আহমেদ। এরপর ধীরে ধীরে বাঙালি সদস্য বাড়তে থাকে। যেহেতু এটি পূর্ববঙ্গের একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ক্লাব ছিল; তাই চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা ও ঢাকা ক্লাবের সদস্যরাও এর সদস্য হতে আগ্রহী ছিলেন। এম এ সাত্তার ১৯৬৭ সালে ক্লাবের প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৯ সালে প্রথম সেক্রেটারি হন এসএমএম হোসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ক্লাবটিতেও বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়। পুড়িয়ে দেয় পুরনো অনেক কাগজ ও নথিপত্র। তাই ক্লাবের অতীতকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না, শুধু প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি।
খড়ের ঘর দিয়ে শুরু গুলশান ক্লাবের
দেশ স্বাধীনের পর অবসর, খেলাধুলা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিকাশের জন্য একটি কমন প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথা ভাবছিলেন গুলশানের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি; কিন্তু সামাজিক ক্লাব গড়তে কিছুতেই মিলছিল না প্রয়োজনীয় জমি। এক সময় সংগঠিত হয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্লট নেন। খড়ের ঘরেই ১৯৭৮ সালে তারা প্রতিষ্ঠিত করেন গুলশান ক্লাব; যা আজ প্রায় সাড়ে চার বিঘার কমপ্লেক্সে পরিচালিত। একে একে নির্মাণ হয় টেনিস কমপ্লেক্স এবং স্কোয়াশ কোর্ট। পরবর্তীতে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যাক্ট ১৯৯৩-এর আওতায় ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অ্যাক্ট অনুযায়ী ক্লাবের নাম নির্ধারণ হয় গুলশান ক্লাব লিমিটেড। শুধু গুলশান, বনানী ও বারিধারার অধিবাসীরাই এ ক্লাবের সদস্য হতে পারেন। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রমও হয়।
সামাজিক ক্লাবটি ১১ সদস্যের বোর্ড অব ডিরেক্টরের মাধ্যমে পরিচালিত। যেখানে একজন সভাপতি, বাকিরা সবাই বিভিন্ন বিভাগের ডিরেক্টর। প্রতি বছরই সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন তারা। ক্লাবটি একটি বিস্তৃত মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা মনে করা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা গর্ববোধ করেন। এটি মূলত ব্রিটিশ ক্লাবের অনুসরণে পরিচালিত হয়। আর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কেবল ব্যবসায়ী নেতা, আমলা, ব্যাংকার, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিল্পী, সেলিব্রিটি এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সামাজের অভিজাত শ্রেণির লোকেরাই। মোট আট ধরনের সদস্য দেওয়া হয়- প্রতিষ্ঠাকালীন, সম্মানিত, স্থায়ী, দাতা, আজীবন সদস্য প্রভৃতি। ক্লাবের নিয়মানুযায়ী সদস্য সংখ্যা ৯০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রয়েছে নির্দিষ্ট ড্রেস কোড, সদস্য ও অতিথিকে সেই মতে ক্লাবে আসতে হয়। ধূতি, লুঙ্গী, জুব্বা কিংবা স্যান্ডেল- একেবারেই নিষিদ্ধ।
গুলশান ক্লাবকে মূলত পারিবারিক ক্লাব বলা হয়, কেননা পরিবারের সব সদস্য বিনোদনের জন্য সেখানে সময় কাটাতে পারেন। প্রথম দিকে খেলাধুলা ছাড়া বিনোদনের জন্য সীমিত ব্যবস্থা ছিল। তবে বর্তমানে ক্লাবের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়েছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ২০০৭ সালে একটি কলোসিয়াম নির্মাণ করা হয়। আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য রয়েছে হল ও অডিটোরিয়াম। আছে গ্রন্থাগার, অতিথিশালা, রেস্টুরেন্ট, লাউঞ্জ, বার, লিভিং অ্যাকোমোডেশন, সুইমিংপুল, বিজনেস সেন্টার, অত্যাধুনিক সেলুন এবং খেলাধুলা ও শরীরচর্চার জন্য টেনিস কোর্ট, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ড ও স্নুকার, কার্ড রুম, জিমনেসিয়াম ইত্যাদির সুযোগ সুবিধা। ক্লাবটি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মিলাদ মাহফিল, বার্ষিক বনভোজন, সংগীতসন্ধ্যা, পিঠা উৎসব, বর্ষবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ফ্যাশন শোসহ নানা আয়োজন করে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন সাইফুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরে এমন কোনো জায়গা নেই আসলে যেখানে বসে কারও সঙ্গে আপনি একটু মন খুলে কথা বলতে পারবেন। অভিজাত হোটেল ছাড়া আমাদের শহরের অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, কোথাও নিরাপদ ও ভদ্রোচিত পরিবেশে প্লেস পাবেন না। তাই আজ ক্লাব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আর গুলশান ক্লাবে যারা মেম্বার হন, তারা জীবনে সম্মানজনক একটি অবস্থানে উঠে এসেছেন ফিন্যান্সিয়ালি এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক দিক থেকে। এ পর্যায়ে একজন মানুষ কিন্তু তার সোশ্যাল ভ্যালুজ বাড়াতে আগ্রহী হন। আর আমরা যাকে মেম্বার করি তার ব্যাপারে বেশ খোঁজখবর নিয়েই করা হয়। যে কেউ আবেদন করলেই কিন্তু মেম্বার হতে পারেন না। শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যাকগ্রাউন্ড, তিনি কী ধরনের মানুষ- এসব বিষয় জানতে আমাদের একটি শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করেই তারা ক্লাবের সদস্য মনোনয়ন দেন।’ ক্লাব ফ্যাসেলিটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্লাবে লাঞ্চ, ডিনারের ব্যবস্থা তো আছেই; এ ছাড়াও সেমিনার, ওয়ার্কশপ করার মতোও পর্যাপ্ত স্থান রয়েছে। সত্যি বলতে কী বাড়ির মতোই আন্তরিক পরিবেশ বিদ্যমান আমাদের এখানে। তাছাড়া মেম্বারদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন। সবাই মিলে যেন একটি বৃহৎ পরিবার। তাই অবসর জীবনে প্রায় সবাই সময় কাটাতে আসেন।’
গুলশান ক্লাবের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গুলশান ইয়ুথ ক্লাব। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার বছর থেকেই এটি বিভিন্ন খেলাধুলা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগে এই ক্লাবের অংশগ্রহণও একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
উত্তরের হাওয়া উত্তরা ক্লাব
রাজধানীর উত্তর প্রান্তে অবস্থিত, তাই বিশাল এলাকাটির নাম ‘উত্তরা’- এমনটাই মনে করেন অনেকে। মূলত ষাটের দশকের শেষ দিকে গিঞ্জি ঢাকা থেকে কিছুটা দূরের খোলা এ প্রান্তরটিকে মডেল টাউন হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরিকল্পনায় রাখা হয় সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে বসতি। নির্জন ও ছায়া-সুনিবিড় এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলটি অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠে। দৃষ্টিনন্দন বাড়ি, বিভিন্ন শপিং সেন্টার ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেশ কিছু স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যও উত্তরা আবাসিক এলাকার সুনাম আছে। এর মধ্যে যখন মোটামুটি জনবহুল অঞ্চলে রূপ নেয় তখনই অভিজাতের ষোলকলা পূরণ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয় একটি কমিউনিটি ক্লাব গঠনে। যেই ভাবনা সেই কাজ। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি, উত্তরাঞ্চলের কয়েকজন বাসিন্দা এ বিষয়ে একটি বাড়িতে বৈঠক করেন। আলোচনা ফলপ্রসূ, নাম চূড়ান্ত হয় ‘উত্তরা ক্লাব লিমিটেড (ইউসিএল)’; কিন্তু কাজ এগিয়ে নিতে হলে তো এর সাংগঠনিক রূপ দিতে হবে। তাই কালক্ষেপণ না করেই ওই বছরের ২০ মার্চ বৈঠকে বসেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ৩০ ব্যক্তি। এ মতিন খানের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ক্লাবটির প্রথম নির্বাহী কমিটি (ইসি)। সেই সঙ্গে ঠিক করা হয় ভিশন ও মিশন। সামাজিক এ ক্লাবটির এখন ৩০ বিদেশিসহ ২ হাজার ৪৭১ সদস্য। এখানে মেম্বারশিপের ধরন চারটি- স্থায়ী, আজীবন, ডোনার ও বিদেশি। ক্লাবের দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্ট ইমরুল আনোয়ার লিটন বলেন, ‘প্রতিটি পরিচয়ই আমাদের কোনো না কোনো বন্ধনে আবদ্ধ করে। এই বন্ধনগুলোই আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়। এই বন্ধনগুলোই আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে। জীবনভর এসব বন্ধন নিয়েই তো আসলে এই আমরা।’
উত্তরা এক নম্বর সেক্টরের নয় নম্বর সড়কে প্রায় দেড় একর জমিজুড়ে নিজস্ব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ক্লাবের অত্যাধুনিক মাল্টিপারপাস ভবন। সদস্য এবং তাদের অতিথিদের জন্য রয়েছে বিস্তৃত পরিষেবা। বার ও লাউঞ্জ, বারবার শপ, বিলিয়ার্ড, কার্ড রুম, স্নোকার অ্যান্ড বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, সিনেপ্লেক্স অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার, হাউজি, বিউটি সেলুন, গ্রন্থাগার ও গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। এখানে জিমনেসিয়ামের পাশাপাশি রয়েছে সুইমিংপুল ব্যবহারের সুবিধা। টেবিল টেনিস খেলা এবং ইয়োগা করার সুবিধা। আর সামাজিক এবং পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে ছয়টি লাউঞ্জ। শিশুদের বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে চাইল্ড কর্নার। ক্লাব সদস্য কিংবা তার অতিথিদের অবকাশযাপনে আছে চমৎকার রেস্ট হাউস। সবার ক্ষুধা মেটাতে রয়েছে উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট। দেশি-বিদেশি সব ধরনের খাবারই মেলে সেখানে।
ভিন্নতার ছোঁয়া ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে
কৈশোরের দুরন্ত সময়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন এক জীবনে বন্দি হয় ক্যাডেটরা। পিটি প্যারেড, খেলাধুলা, পড়ালেখা, রুটিন মাফিক চলা; সঙ্গে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা। নিয়মকানুনও দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। পরিবার ছাড়া যে জায়গাকে পৃথিবী থেকে আলাদা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনে হয়। তবুও একসঙ্গে চলতে চলতে পোক্ত হয় আত্মিক বন্ধন, জীবনের নানা বাঁকেও যা মলিন হয় না। তারই প্রমাণ ক্যাডেট কলেজ ক্লাব লিমিটেড (সিসিসিএল), প্রাক্তন ক্যাডেটদের একটি কমন প্ল্যাটফর্ম। ২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে স্বতন্ত্র এই ক্লাবটি। ক্লাব সংস্কৃতিতে এর সদস্যরা দেশে এক নতুন ধরনের স্মার্টনেস সৃষ্টি করেছেন। নম্রতা ও ভদ্রতা, অতি অল্প সময়ে কীভাবে একটি ক্লাবকে সঠিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে তা তারা পরিশীলিতভাবেই দেখিয়েছেন। পরবর্তীতে এটি পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ক্লাবিং ইতিহাসের এক প্রশংসনীয় ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনেও যে মানুষগুলোর মাঝে শৃঙ্খল ভাঙার সহজাত প্রবণতা কাজ করে। যদিও অনেকেই ভাবেন, ক্যাডেটরা অনেক আত্মকেন্দ্রিক আর অহংকারী। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। পরবর্তী সময়েও বাইরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সমস্যা হয়। সত্যিই কি তাই? ক্যাডেট কলেজ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ ধারণাটা একেবারেই ঠিক নয়, এক্স-ক্যাডেটরা বরং উল্টো। বাবা যত বড়লোকই হোক, ক্যাডেট কলেজে কিন্তু একটি ক্যাডেটকে নিজের জুতা নিজেই পলিশ করতে হয়, কাপড়চোপড় নিজেই ধুতে হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন কিংবা আছেন, তো তারা মানুষের সঙ্গে না মিশতে পারলে ইলেক্টেড হলেন কীভাবে? বারবারই নির্বাচিত হচ্ছেন, কেবল একবার না। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও কিন্তু এক্স-ক্যাডেটরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা যদি সহকর্মীদের সঙ্গে মনখুলে না মিশতেন তাহলে ভোট পেয়ে নির্বাচিত হতে পারতেন না। তারপরও যারা মানুষের সঙ্গে মেশে না, তারা ক্যাডেট কলেজে না পড়লেও মিশতো না।’
ক্লাব প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘ক্যাডেট কলেজে যারা পড়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি হয়। কারণ ১১-১২ বছর বয়সে তারা কলেজে ঢুকে, ১৮-১৯ বছরে বের হয়। কৈশোরের এই পুরো সময়টা একসঙ্গে থাকায় সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়। তাই সবাই সবার সঙ্গে পরবর্তীতেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এক্স-ক্যাডেটদের মধ্যে যে ঐক্য তা কিন্তু অন্যদের মাঝে দেখা যায় না। তবে সবাই তো আর সিসিএলের সদস্য হতে পারবেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্টার্ড হওয়ায় ক্লাবের সদস্য সংখ্যা সীমিত, তিন হাজারের বেশি নেওয়া যাবে না। এখনই সদস্য গিয়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি। অবশ্য বছরে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করা হয় ক্লাবে, যারা মেম্বার হতে পারেননি তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয় সেখানে। তারা আসেন, রিইউনিয়নের মতো একটি পরিবেশ তৈরি হয় তখন।’
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এ ক্লাবটি গড়ে ওঠার পেছনের গল্প টেনে এনে নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, ‘প্রত্যেকটা ক্যাডেট কলেজেরই একটি করে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আছে। সবাই গেট টুগেদার করতো, রিইউনিয়ন করতো। আবার সবার ব্যাচমেটদের মধ্যেও যোগাযোগ হতো। এ পর্যায়ে সিনিয়রদের মাথায় এলো যে, আমাদের এক্স-ক্যাডেটদের জন্য যদি ওঠা-বসার একটি জায়গা করা যায় তাহলে খুবই ভালো হয়। নিজস্ব একটি ক্লাবও হতে পারে। সেই চিন্তা থেকেই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বসা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের দিকে আমরা ঢাকা ক্লাবে একটি মিটিং ডেকে ক্লাব গড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। পরে ওই সময় দেখেশুনে গুলশান-২ নম্বরের কাছেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে ২০০৩ সালে ক্লাবের কার্যক্রম শুরু করি। সদস্য সংখ্যাও ছিল তখন সীমিত। সাত-আট বছর পর গুলশান-১ নম্বরে ক্লাব নিয়ে গেলাম। ওইটাও ভাড়া বাড়ি। পরবর্তীতে পূর্বাচলে নদীর পাড়ে ৯১ কাঠা জমি কিনে ক্লাবের স্থায়ী ঠিকানা গড়ি। ওখানে একটি ভবন তৈরি করে নিজস্ব জায়গায় ক্লাব স্থানান্তর করা হয়েছে এ বছর। দ্বিতীয় ভবনের কাজও চলমান; যেখানে থাকছে সুমিংপুল, বাচ্চাদের সাঁতার শেখার ব্যবস্থা। এ ছাড়া একটি হলরুম থাকবে, যেখানে আড়াইশ’ থেকে পৌনে তিনশ’ লোকের যে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে। ছোট ছোট কয়েকটি মিটিংরুম থাকবে, একটি মসজিদ থাকবে নামাজের জন্য; কার্ড রুম ও আটটি গেস্টরুম করা হচ্ছে। বড় একটি বেকারিও থাকবে, যেখান থেকে সদস্যরা ভালোমানের বেকারিপণ্য পাবেন সাশ্রয়ীমূল্যে। আর এসব হয়ে গেলে মোটামুটি একটি পরিপূর্ণ ক্লাবের অবয়ব পাবে সিসিএল।’
অভিজাত ক্লাব নিয়ে সমাজে নানা অভিযোগের বিষয়ে সিসিসিএল প্রেসিডেন্ট মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, ‘একটি ক্লাব করা হয় মূলত সদস্যদের অবসরযাপনের জন্য। কাজ শেষে হাতে সময় থাকলে সবাই আসে, দেখা হয়, আড্ডা হয়, অর্থাৎ একটি ফেলোশিপ। পারস্পরিক একটি ফেলোশিপের জন্যই ক্লাবগুলো গড়ে ওঠে। তবে এগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটি সহজাত সামাজিক দূরত্ব রয়েছে। কারণ এটা তো একটি প্রাইভেট প্রোপার্টি, যারা এটার মেম্বার সেখানে কেবল তাদেরই ওঠা-বসা হয়। এ জন্য মানুষের ভেতর একটি স্বাভাবিক কৌতূহল থাকে- ওখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে। আবার সব ক্লাবই যে সব আইন-কানুন মেনে চলে, তা কিন্তু নয়। তবে বেশিরভাগই এ বিষয়ে কঠোর। এর ভেতরেও কোনো ব্যত্যয় রয়ে যায়, আর এর ফাঁকগলে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলে সেটাকেই মানুষ মূল ধরে নেয়। ভালো ক্লাবগুলোকে ঘিরেও তখন কানাঘুষা হয়।’
সচেতন চিত্তেই দেশকে তার প্রতিদান দিতে চান রাষ্ট্রের টাকায় আদর্শ শিক্ষা নেওয়া ক্যাডেটরা। আর এ ক্লাবটি সেই লক্ষ্যে কাজ করার একটি প্ল্যাটফর্ম। এ বিষয় মাথায় রেখেই তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও রয়েছে দৃষ্টি। প্রেসিডেন্ট জাহেদী বলেন, ‘ক্লাবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় আমরা এগিয়ে যাই; শীতে বস্ত্র বিতরণ, অনেক সময় দুঃস্থদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা হয়। আবার ক্লাবকে কেন্দ্র করে অনেক সদস্য নানা ধরনের সামাজিক কার্যক্রমেও অংশ নেন। এই যেমন ধরেন- কেউ একজন হয়তো তার গ্রামে একটি স্কুল করতে চান, অনেকেই তখন কন্ট্রিবিউট করেন। আড্ডা-আলোচনার মধ্যেই ভালো ভালো কাজের পরিকল্পনা হয়ে যায় আমাদের। এর বাইরে আমরা অনেক অ্যাওয়ার্নেস প্রোগ্রামও করে থাকি। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশগত বিষয়েও অনেক কাজ করা হয়। বনায়নকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উদ্ভিদের প্রদর্শনী করে থাকি, যেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকার নার্সারির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাদের গাছ নিয়ে আসেন, অডিয়েন্সের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।’ সিসিএল এগিয়ে যেতে চায় শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনেও। ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় তাই কাজ করছে ক্যাডেট কলেজ ক্লাব লিটারেরি সোসাইটি (সিসিসিএলএস)। মূলত কলেজ-জীবনে ক্যাডেটরা শিল্প-সাহিত্য চর্চায় যে পরিমাণ উদ্যমী থাকে, কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অনেকেই তা পরিচর্চার সুযোগ পান না। সে কারণেই প্রাক্তন ক্যাডেট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শিল্প-সাহিত্যচর্চার একটি প্ল্যাটফর্ম সংগঠনটি।
চিটাগাং ক্লাব, ইতিহাস কথা বলে
ভারতবর্ষে চট্টগ্রামের অবস্থানগত গুরুত্ব বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল সুদূর ইংল্যান্ড থেকে বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় এ অঞ্চলে ইংরেজদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য নবাব মীর জাফর আলীর ওপর চাপ প্রয়োগ করে। সফল না হয়ে পরে তারা মীর কাশিমকে একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে নবাব বানায়। সে অনুযায়ী ১৭৬১ সালে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ইংরেজদের দিয়ে দেন মীর কাশিম। চিফ হিসেবে ওই বছরই চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতায় বসেন ব্রিটিশ হ্যারি ভেরেলস্ট। এর পর আরও কতজনই এলো-গেল। বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। ১৮৭৬ সালে চা বাগান মালিক ডব্লিউ এ ক্যাম্পবেল সেখানে একটি অভিজাত ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৮৭৮ সালের ২৩ আগস্ট পুরনো টেলিগ্রাফ কার্যালয়ের কাছে নির্ধারণ করা হয় এর স্থান। ওই দিনই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় চিটাগং বা চট্টগ্রাম ক্লাবের। প্রথম সভার পরপরই শ্বেতাঙ্গ অফিসার ও ব্যবসায়ীরা ক্লাবটিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের তৎকালীন কমিশনার ডি আর লিয়ালের নেতৃত্বে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ইনডোর গেমসসহ সব ধরনের খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি ক্লাবের সদস্যদের পরস্পরের আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে।
এর মধ্যে ‘চিটাগাং ক্লাব’ নিয়ে অন্যরকম একটি ইতিহাস রয়েছে। ওই সময় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ভারতীয় বংশোদ্ভুত কেসি দে (কৃষ্ণ চন্দ্র দে) ক্লাবটির সদস্য হতে চাইলে ইংরেজরা তা প্রত্যাখ্যান করে। কেসি দে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের প্রশাসনিক কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও তাকে ক্লাবের সদস্য পদ না দেওয়ায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। তিনি মনস্থ করলেন ইংরেজ নয়, বাঙালিদের জন্য একটি ক্লাব গঠন করবেন। তার উদ্যোগে সাড়া দিলেন ডা. খাস্তগীর, রায় বাহাদুর বি বি চৌধুরী, ব্যারিস্টার জে কে ঘোষাল, ব্যারিস্টার খাস্তগীর এবং এ কে চন্দ। শহরের জামালখানে নিজের নামে গড়া বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন জায়গাটি দান করলেন ডা. দাস্তগীর। এখানেই ১৯২৭ সালে গড়ে ওঠে ‘চিটাগাং ইনস্টিটিউট’, যা বর্তমানে ‘চট্টগ্রাম সিনিয়র্স ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত।
চট্টগ্রাম ক্লাব বর্তমান স্থলে (এস এস খালেদ রোড) আসে ১৯০১ সালের ২৭ মার্চ। ১৯০৩ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন জমিদার রায় নিত্যানন্দ রায় বাহাদুর পাইওনিয়ার হিলে ক্লাবের জন্য জমি দেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, চট্টগ্রামে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সদর দপ্তর স্থাপন এবং বন্দরের মাধ্যমে পাট রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম ক্লাবেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। নিবন্ধিত কোম্পানি হিসেবে অনুমোদন পায় ১৯০৮ সালে, নামের পেছনে যুক্ত হয় ‘লিমিটেড’। এক সময় ইংরেজ গেল, এদেশ শাসনে এলো পাকিস্তানিরা। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম ক্লাবটি দখল করে পাকিস্তানি সেনারা চালায় বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিচিহ্ন আজও সংরক্ষণ করে রেখেছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। একাত্তরে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া ক্লাবের মূল ভবনের উত্তর কোণের কাচে ঘেরা দেয়ালটি ক্ষত ধারণ করে আছে এখনো।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ক্লাবটি ছিল প্রায় সর্ব শ্বেতাঙ্গ। সদস্য সংখ্যা সীমাবদ্ধ ছিল সর্বোচ্চ একশতে। এর পর সাংগঠনিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। প্রত্যাহার হয় সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যার সীমাবদ্ধতা। দূরীভূত হয় বর্ণবাদী নিষেধাজ্ঞাও। সমাজের উঁচু, বিত্তশালী ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য যোগ্য বলে গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনীকে ৯৯ বছরের জন্য ক্লাবের পক্ষে সমস্ত এলাকাটির মালিকানা দেওয়া হয়। আর এ চুক্তি কার্যকর হয় ১৯৫৬ সালের ২ জানুয়ারি।
বিগত কয়েক দশকে ক্লাবের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে বহুগুণ। ২০১২-১৩ সালে সদস্যদের জন্য নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন চার তলা ভবন। ক্লাবে সাধারণ সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে গেস্ট হাউস কমপ্লেক্স, কেটারিং, বার, বেকস ও ফ্লেক্স, লন ক্যাফে, সি-ম্যাক্স সিনেমা হল, গ্রন্থাগার, সেলুন, নারীদের রূপচর্চা কেন্দ্র, ব্যাঙ্কুয়েট হল, পারিবারিক ডাইনিং হল, সম্মেলন কেন্দ্র, মিলনায়তন কক্ষ। পাশাপাশি ক্রীড়া সুবিধার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য ক্লাব, সুইমিংপুল, হাউজি ও কার্ড, টেনিস কোর্ট, কারাতে, স্কোয়াশ, বাস্কেটবল, বিলিয়ার্ড ও স্নুকার, টেবিল টেনিস, ব্যাডিমন্টন, ক্রিকেট, ফুটবলের ব্যবস্থা। ক্লাবটি বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে থাকে। সাময়িক অবস্থানের জন্য এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি কটেজ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় অডিটরিয়াম, কনফারেন্স রুম, পার্টি সেন্টার, হলরুম, সিনেমা দেখানোর জন্য সি-ম্যাক্স।
বিনোদনের পাশাপাশি বর্তমানে ক্লাবটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ক্লাবটি বক্তৃতা, সেমিনার, আলোচনাসভা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সাংস্কৃতিক ও মানবিক সেবা কর্যক্রমে সহায়তার জন্যও ক্লাবটি তহবিল সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্লাব বিশ্বের অর্ধশতাধিক ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ঐতিহ্যের প্রাচীনত্বের জন্য বিখ্যাত সামাজিক এই প্রতিষ্ঠানটি যেন যুগে যুগে পারিবারিক ক্লাব হয়ে উঠেছে, যেখানে সদস্যরা তাদের পরিবার নিয়ে আনন্দে উপভোগ করতে পারেন সবকিছুই।
‘সাহেবদের ক্লাব’ থেকে খুলনা ক্লাব
অপরূপ নিসর্গ সমৃদ্ধ খুলনাকে বলা হয় শিল্পনগরী। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে এই অঞ্চলটির অধিকাংশ এলাকাই এক সময় চব্বিশ পরগনা ও যশোরের অধীনে ছিল। যশোর, বেনাপোল এবং উত্তরবঙ্গের সঙ্গে স্থলপথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় ইংরেজদের হাত ধরে এই এলাকায় শিল্প-কারখানার কাজও এগিয়েছে দ্রুতগতিতে। তবে ব্রিটিশ আমলে খুলনার বিস্তীর্ণ ভূমিতে হতো নীল চাষ। কাপড়ে রঙ দেওয়ার জন্য সে আমলে বহুল ব্যবহৃত এই নীল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বাধিক লাভজনক পণ্যের একটি। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাই গ্রামে কুঠি স্থাপন করে এর চাষ তদারকি করতেন। তাদেরই একজন চার্লি, যার নামানুসারে খুলনা পরিচিত ছিল চার্লিগঞ্জ হিসেবে। আবার কেউ বলতো সাহেবের বাজার। প্রশাসনের উচ্চপদেও আসীন ইংরেজরা; কিন্তু তাদের মনোরঞ্জনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই ১৮৮৫ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করে খুলনা ক্লাব। যদিও প্রায় সব সদস্য ব্রিটিশ হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে এটি ‘সাহেবদের ক্লাব’ নামেই পরিচিত ছিল। দেশ স্বাধীনের পর স্থানীয়রা ক্লাবে আধিপত্য বিস্তার করেন। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা সাড়ে ছয়শ। বেশিরভাগই এলিট ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সিভিল ও সামরিক কর্মকর্তা, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বহুজাতিক সংস্থা ও ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। সদস্যদের জন্য রয়েছে হেলথ ক্লাব, সুইমিংপুল, লন টেনিস কোর্ট, বিলিয়ার্ড, কার্ডরুম, বার, খাবার রুম, প্রার্থনার স্থান, কনফারেন্স রুম, অডিটোরিয়াম, থাকার জন্য কটেজ। ক্লাবটি কোম্পানি আইনে (১৯৯৪) নথিভুক্ত হয় ২০১১ সালে।
ইতিহাস ঐতিহ্যের দিক থেকেও খুলনা ক্লাব দেশের অহংকার। এটি কেবল সদস্যদের চিত্তবিনোদনেই সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে বাড়িয়ে দেওয়া হয় সহযোগিতার হাত। সমাজের অসহায় দুস্থদের পাশেও দাঁড়ায় ক্লাবটি। দেশ-বিদেশের অভিজাত ক্লাবগুলোর সঙ্গেও ঐতিহ্যবাহী খুলনা ক্লাবের রয়েছে সুসম্পর্ক।
ক্লাব প্রেসিডেন্ট ডা. আরিফউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটি একটি সামাজিক ক্লাব, সদস্যরা তাদের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অবসর সময় কাটান। খুলনা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই মূলত এর সদস্য। দিনভর কাজ করার পর অবসরে চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন, তাই সবার জন্য রয়েছে শারীরিক চর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। অনেকেই মজে যান আড্ডা-গল্পে। কোনো কোনো সদস্য আবার ক্লাবের সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতেও আসেন। ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থাও রয়েছে আমাদের ক্লাবে।’ সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ টেনে ক্লাব প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের ক্লাব সবসময়ই যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগিয়ে আসে। ঘূর্ণিঝড় আইলার সময়ও আমরা চিকিৎসকদের একটি টিম নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনকে চিকিৎসা দিয়েছি। প্রচুর ত্রাণও দেওয়া হয়েছে ক্লাবের পক্ষ থেকে। প্রতি শীতে দরিদ্রদের মাঝে কম্বল ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া খুলনার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের মাধ্যমে গরিব-অসহায়দের চোখের চিকিৎসায় আমরা অর্থায়ন করি। লায়ন্স ক্লাবের সমন্বয়েও করা হয় মেডিক্যাল ক্যাম্প। শিশু হাসপাতালে আমাদের পক্ষ থেকে কেবিন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর নির্মাণেও ক্লাব থেকে ডোনেট করা হয়েছে।’
কালের সাক্ষী সিলেট স্টেশন ক্লাব
উপমহাদেশে চা চাষের শুরু ব্রিটিশদের হাতে। উনিশ শতকের শেষ ভাগে তারা চা বাগান করার জন্য সিলেট আসতে শুরু করে। পাহাড়ি এই অঞ্চলটিকে বিভক্ত করেছিল লস্করপুর, বালিশিরা, দালাই, মনু, লুঙ্গলা, জুড়ী ও উত্তর সিলেট উপত্যকায়। চাষ, বিপণন, রফতানি ও বাগানের মালিকানা- সবকিছুতেই ছিল ইংরেজরা। তবে দিনভর কাজ করার পর কর্মকর্তা, চা-কর ও ব্যবসায়ীদের চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আবার নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রয়োজন হয়ে পড়ে যাত্রাবিরতির। তাই সিলেট শহরটি সাত উপত্যকার কেন্দ্র হওয়ায় ১৮৮৬ সালে তারা সেখানে একটি ক্লাব গঠন করে, নাম দেয় স্টেশন ক্লাব। প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পর অর্থাৎ ১৯১৬ সালে তেলিহাওরের হেমেন্দ্রনাথ দাস এবং শেখঘাটের তিন ভাই বানোয়ারীলাল দাস, বীরেন্দ্রলাল দাস ও বিনোদলাল দাসের কাছ থেকে ক্লাবের জন্য দেড় বিঘা জমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে পারুলবালা দাসের কাছ থেকে আরও এক বিঘা জমি নিয়ে মোট আড়াই বিঘায় শুরু হয় সিলেট স্টেশন ক্লাবের কার্যক্রম। তখন শুধু ইংরেজরাই ছিলেন এর সদস্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তারা ক্লাবের মালিকানা হস্তান্তর করে নিজ দেশে চলে যান। এর পর পাকিস্তানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ক্লাবের সদস্য হতে থাকেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও পটপরিবর্তন। বাংলাদেশিদের দখলে আসে ক্লাবটি। সদস্য হতে থাকেন সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পপতি, অধ্যাপক, সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। কর্মকাণ্ডেও ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। কেবলমাত্র চিত্ত বিনোদনে সীমাবদ্ধ না থেকে ক্লাবের কার্যক্রম প্রসার লাভ করে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। বাংলা সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ, আর্তমানবতার সেবা এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রেও ক্লাবটির উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। অঞ্চল ছাড়িয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ক্লাবের রয়েছে বলিষ্ঠ অবদান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা, সংস্কৃতি, কূটনীতি, ব্যাংকিং, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সবক্ষেত্রেই এর সদস্যদের রয়েছে ঈর্ষণীয় সামাজিক অবস্থান।
সিলেট স্টেশন ক্লাব লিমিটেড এখন শুধু একটি সামাজিক সংগঠনই নয়, বরং অনেক জানা-অজানা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সিলেট অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছেন এ ক্লাবেরই অনেক সদস্য। এদের মধ্যে অন্যতম সর্বজনাব ইসমত আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী, মসউদ আহমদ চৌধুরী, মো. ইউসুফ তারু মিয়া, নির্মল চৌধুরী, বিমলাংশু সেনগুপ্ত প্রমুখ। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে দেশের জন্য প্রাণও দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ক্লাব সদস্যদের এই আত্মত্যাগ ও ভূমিকা আজ ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়।
ছিমছাম আর পরিপাটি আড্ডাঘর হিসেবে সিলেট স্টেশন ক্লাবের জুড়ি নেই। শুরুটা ইংরেজদের হাতে হলেও এর সৌন্দর্যবোধ, রুচি, সৃজনশীলতা এবং নান্দনিকতায় অতীত ঐতিহ্যকে সঙ্গী করেই এগিয়েছে। একসময়ের পাকা আর টিনশেডের ক্লাব এখন বহুতল ভবন। তবে ক্লাব চত্বর আগের মতোই সবুজ-শ্যামল, মায়াময়; বিভিন্ন গাছগাছালিতে ছেয়ে থাকা সুনিবিড় স্নিগ্ধ পরিবেশ। ভেতরে আড্ডা আর হাসি-ঠাট্টায় মত্ত হন সদস্যরা। অবকাশযাপন কিংবা খেলাধুলায় ব্রিটিশরা যেমন ক্লাবে হাজির হতো, এখনো সেটাই চলছে। ক্লাবটিতে রয়েছে হলরুম, ডাইনিং, সুইমিংপুল, টেবিল টেনিস, ক্যারাম, দাবা, কার্ড, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার, ব্যাডমিন্টন, ভলিবলসহ নানা খেলাধুলার স্থান। সদস্যদের চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি এ ক্লাব নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। বিয়ে, জন্মদিন বা অন্যান্য অনুষ্ঠান হয় এখানে। জাতীয় দিবসগুলোতেও পালন করা হয় নানা কর্মসূচি। ক্লাবের সদস্যদের ফি ও অন্যান্য খাতের আয় থেকে দুস্থ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অর্থ দেওয়া হয়। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননাও দিচ্ছে। ‘তিন পতাকা’ ধারণ করে সিলেট স্টেশন ক্লাবের এই নিরন্তর চলা এখন অনেক গৌরবের-সম্মানের।
ক্লাব প্রেসিডেন্ট সদর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ইংরেজ চা-কররা ব্যবসায়িক বৈঠক, বিনোদন এবং একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ক্লাবটিকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করতো। ১৯৪৮ সালে এর দায়িত্ব নেন তৎকালীন সমাজের ৯ অভিজাত ব্যক্তি। সিলেট স্টেশন ক্লাব লিমিটেড দেশের অন্যতম অগ্রণী ক্লাব, যা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে। এরই মধ্যে উদযাপন করেছে গর্বের শতবর্ষ এবং ঐতিহ্যের ১২৫ বছর। ক্লাবের বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় চারশ। নিয়ম মেনে, অন্যান্য সদস্যদের অনাপত্তিক্রমে এ ক্লাবের সদস্য হওয়া যায়। বিদেশি উচ্চবিত্ত, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ক্লাবে প্রবেশাধিকার রাখেন। সদস্যদের আমন্ত্রিত অতিথিরাও ঢুকতে পারেন।’
বিত্তে গড়া চিত্তের ‘বালিশিরা ভ্যালি ক্লাব’
এদেশের চা শিল্প বিকাশে জেমস্ ফিনলে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। জেমস্ ফিনলের ছেলে কিরকম্যান ফিনলে কোম্পানিটির ব্যবসা আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতে বিস্তৃত করেন। ১৮৬১ সালে জন ম্যুর এর অধিকাংশ শেয়ার কিনে নতুন মালিক হন এবং নামকরণ হয় ফিনলে অ্যান্ড মুর; কিন্তু জনসমক্ষে এটি জেমস ফিনলে নামেই পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮২ সালে জন মুর নর্থ সিলেট টি কোম্পানি এবং সাউথ সিলেট টি কোম্পানি নামে দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এসব বাগানের সুবাদেই তখন ব্রিটিশ চা-করেরা সিলেটে আসতেন। তবে আবাসনের ভালো সুবিধা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সেই সঙ্গে ইংরেজ প্রশাসনিক, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা, চা-কর ও ব্যবসায়ীদের সময় কাটানোর জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ-আয়োজন ছিল না। দিনভর কাজ করার পর অবসরে চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার সামাজিকভাবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গেও তারা খুব একটি মিশতেন না। তাই নিজেদের সামাজিক বন্ধ্যত্ব দূর করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বালিশিরা ভ্যালি ক্লাব’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আভিজাত্যের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন কেবল ব্রিটিশরাই ক্লাবটির সদস্য হতে পারতেন।
এদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হলেও চায়ের বাজারে আধিপত্য ঠিকই ধরে রেখেছিল ইংরেজরা। ব্যবসায় মন্দার কারণে একসময় অবশ্য ফিনলে কোম্পানির মালিকানায় বদল ঘটে। নেতৃত্বে আসে এদেশের শিল্পগোষ্ঠী। তবে আভিজাত্য ও অবকাশযাপনের কেন্দ্র হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে বালিশিরা ক্লাব। আশেপাশের চা বাগানের মালিক ও প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতনরা এর সদস্য। রয়েছে শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদ। বালিশিরা ভ্যালি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গোলাম মুহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘পারিবারিক পরিবেশে চলা আমাদের ক্লাবে সভাকক্ষ, সেমিনার কক্ষ, হলঘর, রান্নাঘর ও খাবার ঘর এবং লন টেনিস, ফুটবল মাঠ, ক্রিকেট মাঠ, বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন সুযোগ-সবিধা রয়েছে। বর্তমানে সদস্য রয়েছেন ১০৩ জন। দেশের বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবের সঙ্গেও আমাদের রয়েছে আন্তঃসম্পর্ক। নানা আয়োজন ঘিরে আমরা একত্রিত হই, ভাগাভাগি করি নিজেদের অভিজ্ঞতা।’ ক্লাব প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য, দিনভর কাজ শেষে অবসরে কিছুটা সময় কাটানো। গল্প-আড্ডায় নিজেদের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গাড় করা। শরীর ও মনকে ঠিক রাখতে খেলাধুলার আয়োজন হয়। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দরিদ্র শ্রেণির জন্যও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয় ক্লাব বা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে। এই করোনাকালেও অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছে।’
আড্ডায় আড্ডায় সিলেট ক্লাব
‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’ অর্থাৎ রোম একদিনে তৈরি হয়নি। দেশের অন্যতম অভিজাত ক্লাব ‘সিলেট ক্লাব লিমিটেড’-ও তেমনি একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাকালীন বেশ কয়েকজন সদস্যের অক্লান্ত পরিশ্রম। দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটে নতুন করে একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা ছিল কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের। প্রাথমিকভাবে ২০০৭ সালের এক বিকেলে কয়েকজন ধনাঢ্য বন্ধু ও পরিচিতজন ডা. নাসিম আহমেদের বাসায় জমায়েত হন। সেখানে হাসিন আহমেদই প্রথম প্রস্তাব দেন সিলেট ক্লাব প্রতিষ্ঠার। সবাই এতে রাজি হওয়ায় কয়েক সপ্তাহ এ বিষয়ে তারা ঘন ঘন বৈঠক করেন এবং প্রতিবারই বেড়েছে আগ্রহীর সংখ্যা। সবার প্রচেষ্ঠায় ২০০৮ সালের ২০ জানুয়ারি নগরীর রেইনবো গেস্ট হাউজে ক্লাবটির আত্মপ্রকাশ। ২৫ জন সদস্য নিয়ে শুরু করলেও ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। হাসিন আহমেদ, মুজিবুর রব বাবুল, আবু সুফিয়ান চৌধুরী, আলম চৌধুরী, ফজলে ইলাহি চৌধুরী প্রমুখ ক্লাবটিকে জীবন্ত করে তোলেন। ওই বছরের ১০ এপ্রিল সিলেট ক্লাব লিমিটেড একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। এই আয়োজনটি ক্লাবের সুনাম ছড়িয়ে দেয় শহরজুড়ে। এ সময় ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাব ও মরহুম এনামুল হক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। ক্লাবটিকে পাকাপোক্ত করার জন্য নামমাত্র দামে জমি দেন মুজিবুর রব বাবুল। অবকাঠামো তৈরির জন্য অর্ধকোটি টাকা লোন দেন আফজাল রশিদ। অর্থ সহায়তা দেন আরও অনেকেই। সহযোগী হয়ে এগিয়ে আসে দেশের অনেকগুলো অভিজাত ক্লাবও। বিমানবন্দর বাইপাস রোডের বোরশালায় মনোরম পরিবেশে সিলেট ক্লাব পায় নতুন ঠিকানা। বিশ্বমানের নানা সুবিধাসংবলিত ক্লাবটির বর্তমানে সদস্যসংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে প্রায় প্রতি মাসেই রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়সহ দেশের বিশিষ্টজনদের সমাগমে জমজমাট থাকে ক্লাব প্রাঙ্গণ।
ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আফজাল রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘ক্লাবের সদস্যদের জন্য সুবিধা বাড়াতে আমরা আমাদের নতুন ভবনগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, স্কোয়াশ, সিনেপ্লেক্স, গ্রন্থাগার ইত্যাদির মতো ভালো কিছু নির্মাণের জন্য আরও জমি কেনার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী অন্যান্য মর্যাদাপূর্ণ ক্লাবগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিও আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি। আমরা বিশ্বাস করি, যদি আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারি তবে শিগগিরই সিলেট ক্লাব দেশের সেরা ক্লাব হয়ে উঠবে।’
ত্রিপুরা ক্লাব থেকে কুমিল্লা ক্লাব
শতবর্ষ আগে কুমিল্লার ঐতিহাসিক বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও পাঠাগারের (টাউনহল) পূর্ব পার্শ্বে ছিল বাংলো প্যার্টানের টিনের চৌচালাবিশিষ্ট একটি ঘর। নাম ছিল ‘দি ত্রিপুরা ক্লাব’। অভিজাত শ্রেণির লোকজনের চিত্ত বিনোদনের জন্য ১৯১৭ সালে ত্রিপুরা মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের পরিক্রমায় সেই চৌচালা টিনের ঘর এখন তিনতলা এবং পাঁচতলা বিশিষ্ট নান্দনিক সৌন্দর্যের এক স্বপ্নপুরী। দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ কুমিল্লা ক্লাব। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সমাজকল্যাণ বিভাগের রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী দি ত্রিপুরা ক্লাব থেকে এটির নামকরণ হয় দ্য কুমিল্লা ক্লাব। অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে সেটি দাঁড়িয়ে আছে নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে। অত্যাধুনিক সভাকক্ষ, গ্রন্থাগার, বিলিয়ার্ড রুম, টেবিল টেনিস রুম, জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুল, গেস্টহাউস, কেন্টিন, পার্টিসেন্টার, কার্ডরুম, কনফারেন্স রুমসহ আরও অনেক কিছু ঘিরে ক্লাব সদস্য ও তাদের পারিবারিক সদস্যদের সময় কাটে আনন্দঘন। তিন ক্যাটাগরিতে বর্তমানে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ছয় শতাধিক।