
ফাইল ছবি
গত বছর করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট নানা সংকটের মধ্যেও অর্থনীতি সচল রাখার পদক্ষেপ সফল হওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ইউপি নির্বাচন- এসব ছিল বাংলাদেশে মূল আলোচ্য বিষয়; কিন্তু এতদিন যে ইস্যুই বাংলাদেশের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন; অনেক কিছুকে সম্ভবত ছাপিয়ে গেছে ইউপি নির্বাচনে ভয়াবহ রকমের সহিংসতা। আশপাশে তাকিয়ে, কথা বলে বোঝা গেছে, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বা রাজনীতির বিশ্লেষক- সবার মধ্যে স্থানীয় এই নির্বাচনকে ঘিরে একটা হতাশা কাজ করেছে।
আসলে স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সাধারণ মানুষজনের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক প্রত্যাশা; কিন্তু প্রত্যাশিত নির্বাচনটি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রয়েছে নানারকম চ্যালেঞ্জ। সে সব মোকাবেলায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন কতটা দক্ষ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
২০২১ সালে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে, ২০২১ সালের ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর ৩৬৯টি, এরপর ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৩টি, তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ২ হাজার ৭টি এবং চতুর্থ ধাপে ২৩ ডিসেম্বর ৮৪০টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপে দেশের ৭০৮টি আর ষষ্ঠ ধাপে গত ৩১ জানুয়ারি ২১৮টিতে আর শেষ ধাপ অর্থাৎ সপ্তম ধাপে মোট ১৩৮টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। ভোট চলাকালে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখলের অপচেষ্টা ছিল বলে জানা যায়। কয়েকটি এলাকায় অনিয়মের অভিযোগে ভোট বর্জনের ঘটনাও ঘটেছে। ২২ জেলার ৪২ উপজেলার ২১৮টি ইউপিতে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হয়। এর মধ্যে ২১৬ ইউপিতে ইভিএমে এবং মাত্র দুটিতে ব্যালটে ভোটগ্রহণ হয়। বলা যায়, সব ধাপেই সংঘর্ষ সহিংসতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে তৃতীয়, চতুর্থ আর পঞ্চম ধাপে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ধাপে। ওই ধাপের নির্বাচন ঘিরে ৩০ জন নিহত হয়েছিলেন।
সূত্র বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় আরও ৯২ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ। সব মিলিয়ে ইউপি নির্বাচনে মোট প্রাণহানি ঘটে ১২১ জনের।
হতাশার ব্যাপার হলো, ইউপি নির্বাচনের কোনো ধাপেই ভোট স্বস্তিতে সম্পন্ন হয়নি। কয়েক ধাপের পর থেকেই তাই সাধারণ মানুষের আশঙ্কা ছিল এই নির্বাচনকে ঘিরে। অনেকেই ভেবেছিলেন আগের ধাপগুলোর মতোই সহিংসতা ঘটবে পরের ধাপেও। এই আশঙ্কা কিন্তু অমূলক নয়। কারণ নির্বাচন কমিশন এসব দেখে শুনেও খুব একটা ভেবেছে বলে মনে হয় না, এটা বেশিরভাগ মানুষ বুঝে গেছে। আর হয়েছেও তাই। সব ধাপের ভোটে কম-বেশি সহিংসতা হয়েছে। কোনো কোনো ধাপের ভোটে দেশের বিভিন্ন জায়াগায় মারামারি, হামলা, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। ঠিক কতজন নিহত আর আহত হয়েছেন সেটির স্পষ্ট পরিসংখ্যান সম্ভবত কমিশনের কাছে নেই। সেই সব সহিংসতার খবরকে উল্টো তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে যে আশঙ্কা জনগণের মাঝে তৈরি হয়েছে, তার দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। আর সহিংসতা বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা। কেননা আইন ও বিধিমালায় নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ প্রয়োগ তারা করেনি। করলে এমন ঘটনা পর পর সব ধাপে এত ঘটতো না। ইউপি নির্বাচনের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ ধাপে যেসব সহিংসতা হয়েছিল, সেসব নিয়েও কমিশনের মাথাব্যথা ছিল না বলেই মনে হয়। কেননা তারা সেসব ঘটনার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেই জানা গেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) নির্বাচনে নিহত-আহত নিয়ে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল কিছু দিন আগে। সেখানে তারা জানিয়েছে, ২০২১ সালে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর সেসব ঘটনায় আহত হয়েছেন মোট ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং সাংবাদিক মারা গেছেন একজন।
নির্বাচনে এসব সহিংসতার একটা বড় কারণ হচ্ছে দলভিত্তিক নির্বাচন। এবার দেখা গেছে, বেশিরভাগ সহিংসতা হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে। এ জন্য এটি রোধ করতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা রাজনীতি করেন, তাদের মানসিকতার পরিবর্তনের। এখন অনেকেই মনে করেন, রাজনীতি মানেই দলীয় ফায়দা লাভ, ঠকবাজি করে টাকা কামানো। এই সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ যদি বেরিয়ে না আসতে পারে, এ ব্যাপারে সরকার ও নীতি নির্ধারকরা যদি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করেন, তবে সামনে আরও ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।
নির্বাচন যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত হোক এটা সকলে চায়। যদিও প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই দুর্নীতিমুক্ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ১৯৭২ সালের সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে যে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল, সেটা সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া খুব স্বাভাবিক ও সম্ভব ছিল; কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে যে, তা হয়নি। যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮০ বা ২৭৫ আসনে জয়লাভ নিশ্চিত ছিল, সেখানেও নির্বাচন ঠিক মতো অনুষ্ঠিত হয়নি! ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল টেলিভিশনে প্রচারিত হতে থাকার সময়ে দেখা গিয়েছিল, বেশ কয়েকজন বিরোধীদলীয় প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর থেকে বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন এবং জয়লাভের সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল; কিন্তু সেই অবস্থায় তাদের নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
অনেক পরে যখন আবার তাদের নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো তখন দেখা গেল, তারা আর এগিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত কম ভোট পেয়ে তারা হেরে গেলেন! যারা এভাবে ‘হেরে’ গেলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর আলীম আল রাজী, মেজর জলিল, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে ২৫-৩০ জন বিরোধী প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু একমাত্র আতাউর রহমান খান ছাড়া আর কারও পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে এরপর থেকে প্রত্যেক নির্বাচনেই অল্পবিস্তর দুর্নীতি ও কারচুপি হয়েছে। এভাবে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, অতীতেও নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে প্রায় সব সময়। এই চিন্তা থেকেই বলা যায়, এবার যাতে নির্বাচনে কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য কর্তৃপক্ষের সজাগ হওয়া দরকার ছিল।
নির্বাচনের একটা লক্ষ্য হলো, এর মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। উন্নত ও অগ্রসর দেশগুলোতে সম্পূর্ণভাবে না হলেও এই লক্ষ্য অনেকখানি অর্জিত হয়; কিন্তু অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে সেটা হয় না। আমরা জানি, যখন কোনো দেশ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তখন তার মূল বিষয়ই হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সহাবস্থান এবং সমঝোতা। এর ব্যত্যয় ঘটলেই রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের বর্তমান রাজনীতি স্থিতিশীল মনে হচ্ছে। এ স্থিতিশীলতা যে স্বাভাবিক নয়, তা একজন সাধারণ মানুষও জানেন।
দেশের প্রায় সব নির্বাচনই অঘটনে পরিপূর্ণ। অথচ জনগণ আসলে কী চায়? তারা চায়, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সকলে ভোট দেবে; কিন্তু সেসব হচ্ছে না। আর তাতে আগ্রহ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এখন আর নিশ্চিন্ত মনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করার কথা ভাবে না। শেষ কথা হলো, আগামী দিনে আরও নির্বাচন হবে। সেসব নির্বাচন কতটা কেমন হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে জনগণ।