
ছবি: সংগৃহীত
পিতৃ-মাতৃহীন দরিদ্র শিশুদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত মর্যাদায় সমাজে পুনর্বাসনের জন্য আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় রয়েছে ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবার। এগুলো পরিচালনা করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। আর সমাজসেবা অধিদপ্তর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন।
সরকারি শিশু সদন বা শিশু পরিবার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা এবং শিশু আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এতিম শিশুদের পারিবারিক পরিবেশে স্নেহ-ভালোবাসা ও আদর-যত্নের সঙ্গে লালন-পালন করাই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নিবাসীদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা সাধনে কাজ করা; কিন্তু সরকারি শিশু পরিবারগুলোর পরিচালনা যে সন্তোষজনক নয়।
শুধু তাই নয়, নানা অনিয়মে সরকারি শিশু পরিবারে ভুগছে নিবাসীরা। বয়স কম হওয়ায় ভুক্তভোগী এসব শিশু প্রতিবাদ করতে পারে না ভয়ে। আর সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে সরকারি শিশু পরিবার থেকে পালিয়ে গেছে ২ হাজার ৯১৭ জন শিশু।
জানা যায়, ১৯৬১ সালে শিক্ষা দপ্তর থেকে সরকারি এতিমখানাগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই স্টেট অরফানেজ বা সরকারি এতিমখানাগুলোকে পরবর্তী সময়ে সরকারি শিশু সদন হিসেবে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে পারিবারিক পরিবেশে এতিম শিশুদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও সাহচর্য দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিপালনের জন্য শিশু সদনগুলোকে সরকারি শিশু পরিবারের রূপান্তরিত করা হয়েছে।
১৯৪৪ সালের এতিমখানা ও বিধবা সনদ আইন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের বিধান মোতাবেক পিতৃ-মাতৃহীন বা পিতৃহীন এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের পূর্ণমর্যাদা দেওয়া, তাদের অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অধিদপ্তরের পরিচালকবৃন্দ ও কর্মকর্তারা সদর দপ্তর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়করা সরকারি শিশু পরিবার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠ পর্যায় ও সদর দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে শিশু পরিবার পরিচালনার জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক এই কমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে কাজ করেন।
সূত্র বলছে, সারা দেশে ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশু প্রতিপালনের জন্য রয়েছে ৬টি। বাকি ৭৯টিতে ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী পিতৃহীন ও পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের সরকারি খরচে প্রতিপালন করা হয়। জেলা সদর ও কিছু কিছু উপজেলায় অবস্থিত এসব শিশু পরিবার ৪৩টি বালক, ৪১টি বালিকা ও একটি বালক-বালিকাদের জন্য। এই শিশু পরিবারগুলোতে মোট অনুমোদিত আসনসংখ্যা- ১০৩০০টি। এর মধ্যে বালক আসন ৫৪৫০টি এবং বালিকা আসন ৪৮৫০টি; কিন্তু ১০ হাজার ৩০০ শিশু প্রতিপালনের সংস্থান থাকলেও, সেখানে বর্তমানে ৭ হাজার ৩৮৩ জন ছেলে-মেয়ে আছে। খালি আছে ২ হাজার ৯১৭টি আসন।
সমাজ সেবা অধিদপ্তর বলছে, করোনার সময়ে অনেক শিশু চলে গেছে; কিন্তু আর ফেরত আসেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব শিশু এতিম। তাদের তেমন কেউ নেই। তাহলে তারা চলে যাচ্ছে কেন? কিংবা কোথায় যাচ্ছে, সে তথ্যও অধিদপ্তর জানে না! অভিযোগ রয়েছে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর শিশু পরিবার থেকে বেরিয়ে ৯৮ শতাংশ ছেলে-মেয়ে তাদের কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লাগাতে পারছে না। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের সরকারি শিশু পরিবারগুলোর অসহায় এতিম শিশুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ তারা নিয়ে থাকে। সরকারি শিশু পরিবারগুলোতে থাকা অবস্থায় শিশুরা প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে; কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়ার পর অনেকে বিপথগামী হয়ে পড়ে। এমনকি কেউ কেউ মাদকাসক্ত ও কর্মহীন অবস্থায় চরম অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়ায়। এ অনিশ্চিয়তা দূর করতে শিশুদের শিশু পরিবার থেকে বের হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বিভিন্ন সংকটে থাকে এসব পরিবারের শিশুরা। অনেক সময় বরাদ্দের অর্থ ঠিকমতো খরচ করা হয় না। কয়েক বছর আগে এ সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকায় এসেছিল। কোথাও আবার লোকবল কম থাকায় সেবা পায় না তারা। উদাহরণ হিসেবে পিরোজপুরের শিশু পরিবারের আবাসন ও লোকবল সংকটের কথা বলা যায়। জানা গেছে, এই শিশু পরিবারে (বালিকা) আবাসন ও লোকবল সংকট রয়েছে। ছোট ২টি জরাজীর্ণ ভবনে শিশু ও স্টাফদের কষ্ট করে থাকতে হয়। আর শিশুদের দেখাশোনার জন্য ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও ১১ পদই শূন্য।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, খুব দ্রুত সব সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে। আবার কুমিল্লা সরকারি বালিকা শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ বলছে, বিরাজমান নানা সমস্যা এবং আর্থিক বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে সেখানে অবস্থানকারী একশ’ শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। সরকারি স্বল্প বরাদ্দ দিয়েই এসব শিশুদের খাদ্য-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওই শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষকে। তাছাড়া গণপূর্ত বিভাগ পরিত্যক্ত ঘোষিত করেছে ১৮টি সরকারি শিশু পরিবার ও একটি ছোটমণি নিবাসের হোস্টেল। এগুলো বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পুনর্নির্মাণ করা জরুরি। এ রকম হাজারো সমস্যা নিয়ে চলছে এসব শিশু পরিবার।
সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত ‘কিপিং চিলড্রেন আউট অব হার্মফুল ইনস্টিটিউশন : হোয়াই উই শুড বি ইনভেস্টিং ইন ফ্যামিলি- বেজড কেয়ার’ এ বিভিন্ন গবেষণা ও নানা দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠান আসলে মোটেই নিরাপদ নয়। তাদের বাস করা প্রয়োজন পরিবারে; কিন্তু এতিম এসব শিশুদের ক্ষেত্রে আর কোনো উপায় নেই।