Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

নারীর কাজে ফেরার চ্যালেঞ্জ

Icon

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২, ০৯:২১

নারীর কাজে ফেরার চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী; কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা অনেকটা পিছিয়ে। করোনাকালে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেক কর্মজীবী নারী।

করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে নারীদের সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ছিল তৈরি পোশাক খাত, হোটেল রেস্তোরাঁসহ সেবা খাত, আবাসন, কৃষি খাত ও গৃহকর্মী হিসেবে। করোনা নারীদের এই কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো ওলট-পালট করে দিয়েছে। চাকরি হারানোর পাশাপাশি নারীরা সহিংসতারও শিকার হচ্ছেন। করোনাকালে নারীদের প্রতি অর্থনৈতিক চাপ ও পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। 

করোনা সংকটে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ হারালেও, পুরুষের চেয়ে নারী কর্মজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ পুরুষরা দ্রুত অন্যত্র কাজ খুঁজে নিলেও, নারীর ক্ষেত্রে এ সুযোগ কম। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা কাজ হারিয়েছেন বেশি। মহামারিতে এসব খাতে কর্মরত নারীরাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে পোশাক খাত এবং হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক, প্রবাসী নারী শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও গৃহকর্মে জড়িত নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা মতে, করোনায় নারী নেতৃত্বাধীন পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাটির গবেষণায় বলা হয়, মহামারিতে নারীপ্রধান পরিবারের ৫৭ শতাংশেরই কোনো উপার্জন নেই। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের (গ্যাড অ্যালায়েন্স) তথ্যানুযায়ী, লকডাউনের সময় থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। এমনকি করোনায় নারীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বেড়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও। 

পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, মহামারিতে পোশাক খাতের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। বেসরকারি খাতে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন। কারও কারও বেতন কমানো হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পুঁজি হারিয়েছেন। এ অবস্থায় অনেক গৃহকর্মী ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব নারী সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী তারা গোটা পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই শহর ছেড়েছেন ফিরে গেছেন গ্রামে। গ্রামে ফিরেও সংসারের অভাব মোচন করা যাচ্ছে না। অনেক নারীর কাজ বাজার নির্ভর। তারা বাজারে গিয়ে নিজেদের পণ্য বিক্রি করেন; কিন্তু মহামারির ফলে বাজার নির্ভর সেই অর্থনীতি কমে গেছে।

ফলে যেসব নারীর জীবিকা বাজারনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা উপার্জন করতে পারছেন না। এ ছাড়া যেসব নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা ছিলেন তারা নিজেদের আয় দিয়ে ব্যবসা চালাতেন; কিন্তু আয় ও ব্যবসা চালানোর চক্রাকার ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তাদের ব্যবসাও নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে এ উদ্যোক্তাদের পুঁজিও। 

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নতুন উপাত্ত মতে, করোনাভাইরাস মহামারির জেরে চরম দারিদ্র বেড়েছে। নারী দরিদ্র হচ্ছেন বেশি। কাজের সুযোগ, আয়, স্বাস্থ্য, অবৈতনিক শ্রম এবং সহিংসতা- সব দিক দিয়ে নারীর অবস্থান আরও নাজুক ও অসম হয়েছে। নারী পুরুষের সমতা যেটুকু অর্জিত হয়েছে, তা ঝুঁকিতে পড়ছে। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীদের বাস্তবসম্মত প্রয়োজন পূরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই উন্নয়নে সমাজের সর্ব স্তরের সব ধরনের মানুষকে অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স অনুসারে, নারীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ১৪৯টি দেশের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পঞ্চম স্থানে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থানে রয়েছে দেশটি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) দেওয়া তথ্যানুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ হারিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ১ হাজার ৯১৫টি। তৈরি পোশাক খাতে দেশে বর্তমানে ৪২ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। এর ৮০ শতাংশই নারী। এ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানাগুলোর বেকার শ্রমিকের সিংহভাগই নারী। 

করোনার কারণে সারা দেশের গার্মেন্ট কারখানা থেকে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যার ৭০ শতাংশ নারী। কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশে ফিরে আসা প্রবাসী নারী শ্রমিকরাও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ থেকে কাজ হারিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি নারী। পোশাক খাতের পর বেশিসংখ্যক নারী গৃহকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ কেউ ছোট হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁয়ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাব মতে, দেশে গৃহ শ্রমিক ২৫ লাখের বেশি। ৪ লাখের বেশি গৃহকর্মী শিশু, যার ৮৩ শতাংশ মেয়ে। করোনা সংকটের মধ্যে অনেক পরিবার নিজেদের সুরক্ষার কথা ভেবে ও টাকা বাঁচাতে এসব গৃহকর্মীকে কাজে আসতে বারণ করেছে। ফলে এ খাতে কর্মরত অনেক নারীও বেকার হয়ে পড়ছেন। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মোট উদ্যোক্তা রয়েছেন ৭৮ লাখ, যার ৪০ শতাংশই নারী; কিন্তু করোনার ফলে এদের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ নারীই ঝরে পড়েছেন। 

নারী উদ্যোক্তার একটা বড় অংশ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত; কিন্তু করোনার মধ্যে কৃষিপণ্য বিপণনে সীমাবদ্ধতার জন্য তাদের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের আরেকটি বড় খাত হলো বিউটি পার্লারের ব্যবসা। এ খাতে সারাদেশে লাখ লাখ নারী কর্মরত ছিলেন। এ খাতের অনেক নারী উদ্যোক্তাই ক্ষতির মুখে এ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। 

তবে নারী উদ্যোক্তারা করোনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আশা জাগানিয়া সংবাদ হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে নতুন করে ব্যবসাকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। ক্রেতা অনলাইনে পণ্য দেখে অর্ডার করছেন এবং সময়মতো তা হাতে পেয়ে টাকা পরিশোধ করছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫