ছবি: সংগৃহীত
দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নেই। সোয়া কোটি বাংলাদেশিকে তাই কাজ করতে হচ্ছে দেশের বাইরে গিয়ে। অথচ এদেশের শিল্পকারখানায় আছে কয়েক লাখ ভিনদেশি। বেশিরভাগেরই আবার কোনো পারমিট বা বৈধ কাগজপত্র নেই। মূলত পড়াশোনা, চাকরি, খেলোয়াড়, ব্যবসা কিংবা ট্যুরিজম- এমন অন্তত ৩৪ ক্যাটাগরির ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন তারা। পরবর্তীতে বড় একটি অংশই হয়ে পড়ছেন অবৈধ। বৈধ-অবৈধ পথে আয় করছেন বিশাল অংকের টাকা।
তথ্য মতে, সিংহভাগ বিদেশিই তাদের আয় নিজ দেশে পাঠায় হুন্ডির মাধ্যমে, যার ন্যূনতম বার্ষিক পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এতে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রশাসনের ঢিলেমির সুযোগে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ বিদেশিরা। অস্ত্র, সোনা ও মাদক চোরাচালান, জাল মুদ্রার কারবার, এটিএম কার্ড জালিয়াতি এমনকি জঙ্গি কর্মকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর জামিনে এসে ফের অপরাধে জড়াচ্ছেন। স্থানীয় কিছু অপরাধীচক্র এসব কাজের সহযোগী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশিদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে গত কয়েক বছরে। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, ধানমন্ডি, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় বসবাস করছেন কয়েক হাজার অবৈধ বিদেশি; যাদের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। তাদের ধরতে মাঝে-মধ্যে অভিযান চালানো হলেও, চক্রের ধারেকাছেই পৌঁছতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না, তাদের অপতৎপরতা। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার সহস্রাধিক বিদেশিকে বার বার দেশে ফেরানোর চেষ্টা করেও, কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এদের মধ্যে আফ্রিকার দেশ- নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, কঙ্গো, ঘানা, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, মরক্কো, সুদান, ইথিওপিয়া থেকে আসা লোকের সংখ্যাই বেশি। আছে পাকিস্তান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ইরাক, আফগানিস্তান, চীন, ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের নাগরিকও।
পুলিশের বিশেষ শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে যে ৪৮টি রাষ্ট্রের দূতাবাস বা চ্যান্সেলর অফিস আছে, সেসব দেশের প্রচুর নাগরিক এদেশে যাতায়াত করেন। এর বাইরেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যাতায়াতের বিষয়ে চুক্তি রয়েছে। সে অনুযায়ী, দেশগুলো থেকে কেউ এলে বিমানবন্দরে ভিসা (পোর্টএন্ট্রি) দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে অন্তত শতাধিক দেশের নাগরিক নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করেন।
তিনি আরও জানান, যখন কোনো নাগরিক ভিসার মেয়াদের অতিরিক্ত সময় থাকবেন, নিয়মানুযায়ী তাকে নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়; কিন্তু যে সব বিদেশি অপরাধের মিশন নিয়ে আসে, তারা দেশে ঢুকেই পাসপোর্ট ও ভিসাসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র গায়েব করে ফেলে। এদেশীয় দালালদের মাধ্যমে তারা বাড়ি ও মোবাইল ফোনের সিমকার্ড পায়। আফ্রিকানদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা পাওয়া যায় বলে ফ্ল্যাট মালিকরাও তাদের বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহী। তাই এক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-কানুন আছে, তা অনেক সময় মানা হয় না। মূলত কাউকে বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে, তার পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ এবং তা সঠিক কি-না, তা যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একইসঙ্গে পাসপোর্ট নম্বর, নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য স্থানীয় থানায় জমা দেওয়ারও বিধান। আর এসব নাগরিকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং সময়ে সময়ে তথ্য যাচাই করা বিধি অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব।
পুলিশ অবশ্য বলছে, ঘন ঘন স্থান পরিবর্তনের কারণে বেআইনিভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের ধরা সম্ভব হয় না। আবার তাদের প্রায় সবাই স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে। এ কারণে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেগ পেতে হয়।
প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতায় সীমা ছাড়াচ্ছেন তারা : স্পেশাল ব্রাঞ্চ ইমিগ্রেশন পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কেবল বিদেশিদের আসা এবং অবস্থানের বিষয়ে জানা যায়। তবে কেউ গা-ঢাকা দিয়ে বা ভুয়া পরিচয়ে চললে, তা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নেই এদেশে। এমনকি অবৈধ বিদেশিদের ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্তও নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে। নানা প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে দেশে অপরাধের আস্তানা গেড়ে বসেছে বিদেশি অপরাধীচক্র। সেইসঙ্গে বাধাহীন বসবাসের সুযোগ পেয়ে আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্রের সদস্যরাও ঢুকে পড়ছে। দিন দিনই এদেশকে করে তুলছে অস্থিতিশীল।
এ প্রসঙ্গে অপরাধবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর উন্নত বিশ্বে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পেছনে গোয়েন্দা নজরদারি থাকে; কিংবা তাদের আইডেনটিফাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ইলিগ্যাল ভিসায় বেশি দিন থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটকও করা হয়। আমাদের এখানে এমন নজরদারির ব্যবস্থা নেই বলেই বিদেশি অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। তাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে হুমকিতে পড়ছে দেশের নিরাপত্তা।’
দেশে সাধারণত তৈরি পোশাক, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। এ সুযোগেই প্রচুর ভিনদেশির আনাগোনা এ দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের সহযোগিতায় সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি পরিচালিত এক সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। এদের এক-পঞ্চমাংশই কেবল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব বিদেশি এসব খাতে কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগই মাঝারি পর্যায়ের সুপারভাইজার ও ম্যানেজার। তাদের আবার কাজ করার কোনো বৈধ অনুমোদন নেই। অথচ এভাবে কোনো বিদেশির কাজ করা সম্পূর্ণভাবে আইনের লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইসঙ্গে দেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।
মূলত ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা এ সুযোগটা পাচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান শুধু বৈধ বিদেশিদেরকেই নিয়োগ দিতে বাধ্য- সরকারও এমনটি নিশ্চিত করতে পারেনি। তদারকির না থাকার সুযোগ নিয়ে বহু অবৈধ বিদেশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে, এমনকি শিশুদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ করছেন। এদের সবাই আবার দীর্ঘ দিন থাকেন না। যাওয়া-আসা করেন পর্যটন ভিসায় কিংবা আমন্ত্রণপত্র নিয়ে। নিজেদের স্বার্থে তাদের এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে সহায়তা দিয়ে থাকেন নিয়োগদাতারাই। অনেক বিদেশি বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত খুলেছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাহায্যে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অধিকাংশ বিদেশির বাংলাদেশে আগমন, অবস্থান ও কর্মসংস্থান আইন মেনে হয় না। তারা চাকরি করতে এলেও পর্যটন, অন অ্যারাইভাল কিংবা বিজনেস ভিসায় আসেন। নিয়োগদাতাদের যোগসাজশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই তারা চাকরি করেন। কর ফাঁকি দিতে বিদেশিদের সঠিক বেতনও ঘোষণা করে না নিয়োগদাতারা। এর ফলে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে।’
বিদেশিদের হদিস সরকারিভাবে রাখা হয় না অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এদের সব তথ্য সংরক্ষণ, বেতনের সীমা হালনাগাদসহ যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা জরুরি।’
ফুটবলে লাথি মারতে পা কাঁপে তবুও ফুটবলার! : বাংলাদেশ যেন আফ্রিকান ফুটবলারদের পুন্যস্থান। মাঠে নামতে পারলেই পাওয়া যায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। অথচ বিভিন্ন ক্লাবের চিঠি নিয়ে এদেশে ঢোকা অনেকে ঠিকমতো ফুটবলে লাথিও দিতে পারেন না। এমনকি তাদের না হয় কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা, না আছে ভিসার মেয়াদ। দেখারও কেউ নেই। ফুটবল মৌসুমে তারা প্রায় প্রতিদিনই খেপ মেরে বেড়ান। ‘বিদেশি ফুটবলার’ হওয়ায় ইদানীং শহরের বাইরে গ্রামেগঞ্জেও বেড়েছে তাদের চাহিদা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।
তাই এ সময়টা চলতে কোনো অসুবিধাই হয় না; কিন্তু বছরের বাকি সময় তেমন কোনো কাজ না থাকায় অনেকেই জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপকর্মে। তাদের অনেকেই আবার আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সদস্য। বছর কয়েক আগে নাইজেরিয়ান যুবক ইসি আকা হিনলি ফুটবলার পরিচয়ে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকার একটি ক্লাবের হয়ে খেলতে চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন তিনি; কিন্তু পরবর্তীতে একটি ম্যাচও খেলেনি। এর মধ্যে বেসরকারি এক ব্যাংকের নারী কর্মকর্তাকে বিয়ের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় ২২ লাখ টাকা। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, ডিবির জালে গ্রেফতার হয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে।
রাজধানীর শাহজাদপুরে সম্প্রতি দেখা হয় আফ্রিকান এক যুবকের সঙ্গে। দীর্ঘ সময় কথার একপর্যায়ে নিজেকে পরিচয় দেন ওবায়দুবাহিমেন আদামু নামে। নাইজেরিয়ার ছোট্ট শহর অ্যাংগোয়া অ্যালোরার এই বাসিন্দা ফুটবলার হিসেবে বছর তিনেক আগে এসেছেন ঢাকায়। এখানে কোন ক্লাবে খেলেন- জানতে চাইলে শুরু হয় তার আমতা আমতা। হাঁটেনও ডান পা খুড়িয়ে। ভাঙা এই পা নিয়ে ফুটবল খেলা সম্ভব কি-না প্রশ্নে আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন আদামু। বাংলাদেশে থাকার বৈধ কাগজপত্রের প্রসঙ্গ তুলতেই দ্রুত পালিয়ে যান। ঢাকার রাস্তায় আদামুরা এখন বেশ চেনা মুখ। রাস্তায়, যানবাহনে, মার্কেটে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ বাঙালিদের মতোই। পুলিশ অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর কথা বললেও, বাস্তবে তেমন কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। কোনো অপরাধ হলেই কেবল নাড়াচাড়া দেওয়া হয়। অপরাধীরাও জানে, ভিসার মেয়াদ পার হলেও এদেশে থাকতে খুব বেগ পেতে হয় না। এ কারণে যত আফ্রিকান আসে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই থেকে যান। কেউ কেউ এদেশের মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ী বসবাসেরই স্বপ্ন দেখছেন। কেউ আবার কৌশলে চলে যান ভারতে। কিছু আছেন, যারা গার্মেন্ট শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানায় গোপনে কাজ জুটিয়ে নেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসীদের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হবে। তবে নানা অপরাধে জড়িতদের, বিশেষ করে গ্রেফতারকৃত আফ্রিকানদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলে না। তাদের পাসপোর্ট বা বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কোনো কাগজপত্রও পাওয়া যায় না। নাম-ঠিকানা যাচাই করারও ন্যূনতম সুযোগ থাকে না তখন। আর সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় তাদের দেশে পাঠাতেও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়।’
