ঋণের বোঝায় ভিক্ষাবৃত্তিতে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রোজিনা

রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২২, ১৫:৩৭

রোজিনা খাতুন
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’ কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই। চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’-বিশ্বকবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার প্রতিনিধিত্বকারী উপেন চরিত্রের একটি বড় অংশ যেন ধারণ করেছে রাজশাহীর শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী রোজিনা খাতুন।
জন্মের পরপরই সংগ্রামী এই নারীর ভাগ্যাকাশে জমেছে কালো মেঘ। মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই হয়েছেন এতিম। হতদরিদ্র পরিবারে বিধবা মায়ের কোলে এসেছেন চরম অপুষ্টি নিয়ে। এরপর হঠাৎ চার বছর বয়সে হয় পোলিও জ্বর। এই জ্বর কোনো সামান্য জ্বর ছিলো না। সেই জ্বর তাকে শারীরিক প্রতিবন্ধী করে গেছে। তবে জীবনযুদ্ধে আশা-ভরসা হয়ে ছিলেন জননী মা। বাবা হামেদ আলীর পরে মা আলিমনই ছিলেন বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।
হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে সেই সম্বলটিকেও নিয়ে গেছেন স্রষ্টা। গত বছরের ১৪ নভেম্বর স্টোক করে পরলোকে পাড়ি জমান মা আলিমন। মায়ের স্বপ্ন পূরণে নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন রোজিনা খাতুন। সে এখন দেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। অর্থাভাবে যখন সে কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছিলো না সে সময় তার পড়াশোনার সকল খরচ বহনের সিদ্ধান্ত নেয় রাজশাহী কলেজ প্রশাসন। তবে তার দেনার বোঝা মাথায় নেয়নি কেউ। তাই তো শহরের পথে পথে ঘুরে সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছেন রোজিনা।
রোজিনা খাতুন রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমুইল ইউনিয়নের পরিজুনপাড়ার বাসিন্দা। বর্তমানে তার বয়স ২৯ বছর। মা আলিমন ও বাবা হামেদের কনিষ্ঠ মেয়ে সে। বড় ভাই এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে দিনযাপন করেন। বড় বোন ফাহিমা বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। রোজিনা ২০১০ সালে কেশরহাট নাকইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ২০১২ সালে পুঠিয়ার পঙ্গু শিশু নিকেতন সমন্বিত অবৈতনিক ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর মোহনপুর দাউকান্দি কলেজে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স শেষ করেন।
রাজশাহী নগরীর জনবহুল সাহেব বাজার এলাকায় রোজিনাকে বেশ কিছুদিন ধরে ‘আমি পঙ্গু মানুষ, আমাকে সাহায্য করুণ’ লিখা সম্বলিত ফেস্টুন গলায় টাঙিয়ে সাহায্য চাইতে দেখা যায়। জীবন সংগ্রামের এই পর্যায়ে এসে কেন ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিলেন এমন প্রশ্ন করতেই আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি ভিক্ষুক না। আমি মানুষের কাছে সাহায্য চাই। এছাড়া আমার কোনো উপায় নাই।
কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি জানান, তার মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন বলতে দেড় বিঘামতো জমি ছিলো। অভাবের সংসারে যখন তার মা অসুস্থ হতে শুরু করে তখন সেই জমি তিন বছরের জন্য বন্ধক রেখে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন। সেই টাকা মায়ের চিকিৎসায় খরচ করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি। মা পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। আর এদিকে মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও হারাতে বসেছেন। এই টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সেই জমিও হারাবে। এরই মধ্যে টাকা পরিশোধের সময় পেরিয়েছে। ঋণও জমেছে। তার অন্তত তিন লাখ টাকার প্রয়োজন।
তিনি আরো জানান, নিরুপায় হয়ে পথে নেমেছেন। চাকরির অনেক খোঁজ করেছেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী বলে কেউ চাকরি দেয় না। জমিটুকু ফেরাতে গ্রাম থেমে শহরে এসেছেন। সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক জানান, বাবা-মা হারানো রোজিনা পঙ্গুত্ব জীবনের এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও যেভাবে অদম্য সাহস ও ইচ্ছাশক্তি নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এটা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা। তবে তার পারিবারিক সমস্যার কারণে পথে পথে সাহায্যের জন্য নামতে হচ্ছে এটা অপ্রত্যাশিত। তার পারিবারিক বিষয়টা জানা ছিলো না। তবে তার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ কলেজ কর্তৃপক্ষ বহন করছে। এখন তার ঋণগ্রস্ততার বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজের প্রভাবশালীরা যদি দেখতেন তাহলে তার জন্য ভালো হতো। তবে কলেজের পক্ষ থেকে যতটুকু করার তিনি করবেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শবনম শিরিন জানান, প্রতিবন্ধী হিসেবে তিনি সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। এখন তার ঋণগ্রস্ততার বিষয়টি দূরীকরণে সরাসরি তাকে সহযোগিতা করার মতো ফান্ড তাদের নেই বা সুযোগও নেই। তবে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে সহযোগিতা করতে পারেন।