করোনার টিকা : টিআইবির হিসাবে ২২ হাজার কোটি টাকার ফারাক

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৪৮

প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এক্ষেত্রে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ফারাক দেখা যাচ্ছে।
আজ মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এক গবেষণা প্রতিবেদন উত্থাপনের মাধ্যমে এই দাবি করে টিআইবি। ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এই গবেষণা প্রকাশ করে টিআইবি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত মার্চ মাসে বলেছিলেন, কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় ও বিতরণের ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই খরচ সর্বোচ্চ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হবার কথা নয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, টিকা ক্রয়ে খরচ হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব টিকা কত দামে কেনা হয়েছে তার বিস্তারিত কখনোই তুলে ধরেনি স্বাস্থ্য বিভাগ।
টিআইবি তাদের গবেষণায় বলছে, টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবার কথা নয়। যেহেতু সরকারের তরফ থেকে টিকার দাম সম্পর্কিত কোনো তথ্য তুলে ধরা হয়নি, সেজন্য টিআইবি বিভিন্ন সূত্র থেকে টিকার দাম সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করেছে।
টিআইবির গবেষক মোহাম্মদ জুলকারনাইন বলেন, কোভ্যাক্স রেডিনেস এন্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর টিকার পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে। এই মডেলের মাধ্যমে তারা দেখিয়েছে টিকা প্রতি খরচ কেমন হতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, এখানে বলা হয়েছে টিকা প্রদানের সাথে যত খরচ সম্পৃক্ত - অর্থাৎ টিকা পরিবহন, সংরক্ষণ, টিকাকর্মী নিয়োগ এবং তাদের বেতন-ভাতাসহ সকল খরচ তিনটা বিষয়ের উপর তারা প্রাক্কলন করেছে। টিকা কার্যক্রমের বিদ্যমান অবকাঠামো, জনবলের ব্যবহার ও আউটরিচ কেন্দ্রের অনুপাত বিবেচনায় তারা প্রতি ডোজ টিকার ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয় ধরেছে ৭১ দশমিক ৪ টাকা থেকে ২২৪ দশমিক ৪ টাকা।
টিকা ক্রয় ও দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে হিসেব দিয়েছে সেখানে স্বচ্ছতার ঘাটতি আছে বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, সরকার যেহেতু টিকা কার্যক্রমের খরচ নিয়ে বিস্তারিত ও স্বচ্ছ হিসাব দেয়নি, সেজন্য তাদের নির্ভর করতে হয়েছে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রের উপর। সে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে কথা বলছেন তার তুলনায় বাস্তব ব্যয়, নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী অর্ধেকের মতো হয়েছে।
তিনি বলেন, এই ঘাটতি বাস্তবে হয়েছে কিনা সেটি তাদের জানা নেই। যেহেতু সরকার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করছে না বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ১৭ হাজার কোটি খরচ হয়েছে। এই তারতম্যের কারণ হচ্ছে, তথ্য প্রকাশে ঘাটতি ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, কোনো দুর্নীতি সুরক্ষা করার জন্য অবাধ তথ্য প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে কি না?
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ টিকা গ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিল। ৭৫ শতাংশ মানুষ পরিবার-আত্মীয় স্বজনের এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে টিকা বিষয়ে জেনেছে। ৬৬ শতাংশ টিকা গ্রহীতাকে টাকার বিনিময়ে দোকান থেকে নিবন্ধন করতে হয়েছে।
টিআইবির এই গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি।
তবে টিআইবির গবেষণায় ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে-সারা বিশ্বে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। একক উৎসের ওপর নির্ভতার ফলে ২৬ এপ্রিল ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চীন থেকে টিকা ক্রয়, কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে কস্ট শেয়ারিং বা বিনামূল্যে টিকা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়।
টিকা সংগ্রহে সরকারের তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ২৯ দশমিক ৬৪ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। সংগৃহীত টিকা থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১২ দশমিক ৭৭ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ (মোট জনসংখ্যার ৭৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ) এবং ১১ দশমিক ২৪ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ (৬৬ শতাংশ) টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করা হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে এবং এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষকে বুস্টার ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন পেশা-জনগোষ্ঠীর মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি থেকে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
এছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।