Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বাংলা নববর্ষ

কৃষকদের ওপর অত্যাচারের দিনও বটে

Icon

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২২, ০৯:৫৮

কৃষকদের ওপর অত্যাচারের দিনও বটে

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। সেই একই দিনে বা তার একদিন আগে পরে নববর্ষ পালিত হয় বা হতো কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভারতের উড়িষ্য, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং মণিপুরে। বাংলাদেশে যখন নববর্ষ পালিত হয়, ঠিক তার একদিন আগে বা পরে নববর্ষ পালিত হয় থাইল্যান্ড, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরালা, মনিপুর, আসাম ও অরুণাচলে।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশশক্তি নিরীহ পাঞ্জাববাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করে, সেদিন ছিল সেখানে পহেলা বৈশাখ। অমৃতসরের পহেলা বৈশাখের মেলায় সেদিন বহু মানুষ উপস্থিত ছিল। পাঞ্জাবের কৃষকরা পহেলা বৈশাখ পালন করে চাষাবাদের উদ্দেশ্যে স্রষ্টার আশীর্বাদ লাভের জন্য, শিখরাও ধর্মীয়ভাবে খুব ঘটা করে এই দিবসটি পালন করে। পাঞ্জাবে সাধারণত দিবসটি পালিত হয় ১৩ বা ১৪ এপ্রিল ইংরেজি দিনপঞ্জির সাথে মিল রেখে। যারাই ১৪ এপ্রিলের আশপাশে নববর্ষ পালন করে, তারা প্রধানত সেটা করে চাষাবাদকে ঘিরে।

প্রাচীন ভারতে সূর্যের গতিপথকে ঘিরে বহু বছর ধরে এই সময়ে নববর্ষ পালিত হতো। সেখান থেকেই তা বৌদ্ধদের দ্বারা থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বারাও কিছু অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্যই দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু জায়গার সাথে ভারতের সংস্কৃতির কিছু কিছু মিল রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে নববর্ষ পালনের কিছুটা মিল রয়েছে আরো অনেক দেশের।

মুসলমানরা ভারতবর্ষে আগমনের পর হিজরি বছর চালু করলে আগের নিয়মে সূর্যবছর পালন আর হতো না। হিজরি মাস চন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল বলে তাতে চাষাবাদের ঋতু পালন করা বা নিদিষ্ট সময়ে খাজনা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আকবর পুনরায় তাই সূর্যবছর চালু করেন যা বর্তমানে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, পাঞ্জাব এবং নেপালেও নববর্ষ হিসেবে পালিত হচ্ছে। মুঘল শাসিত সারা ভারতবর্ষ জুড়েই সেই রকম বছর চালু করা হয়েছিল, শুধু বাংলার জন্য নয়। বিভিন্ন দেশের ভাষার তারতম্যের জন্য তার নামের তারতম্য হয়ে থাকবে। আকবরের সময় প্রথম একে ‘ফসলি সন’ বলা হতো পরে বাংলায় বঙ্গাব্দ কথাটা চালু হয়। মুঘল সম্রাট আকবর ক্ষমতায় বসার পর থেকেই আবার এ সূর্য বছরটি পালন করতে শুরু করেন। নতুন এই বছর আকবর কবে ঠিক শুরু করেছেন, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মনে করা হয়, তা ১৫৮৪ সালে আরম্ভ হয়েছিল। তবে দিনটিকে আকবরের ক্ষমতায় বসার সাল ‘১৫৫৬’ থেকে গণনা আরম্ভ করা হয়।

ব্রিটিশরা ভারতের ক্ষমতায় আসার পরে নানা প্রদেশে মুঘলদের দ্বারা চালু করা এই বছর পালন বাদ দিয়ে সেখানে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি মেনে বছর পালন করা শুরু হয়। বহু প্রদেশ সেই কারণে এই ঐতিহ্যবাহী বছরটি আর পালন করতো না, অনেকে হয়তো এই ধরনের বছর পালনের কথা ভুলেই গিয়েছিল। বা তা পালন করতে খুব উৎসাহ দেখায়নি। তামিলনাড়ুতে যেমন দেখা যায়, উনিশশো আট সালে সরকার আইন করে ১৪ এপ্রিলকে তাদের বছর হিসেবে ঘোষণা দেয়। ভিন্নভাবে আবার রাজস্থান, অন্ধ্র, জম্মু ও কাশ্মীরে ইংরেজি নববর্ষই পালিত হয়।

ইংরেজদের আগমনের আগের নববর্ষ আর এখন সেখানে পালিত হয় না। যদি পালিত হয়ে থাকে তা তেমন আলোচ্য নয়। কারণ ইংরেজ প্রভাবই সেখানে রয়ে গেছে, সেজন্য উল্লেখিত স্থানগুলোতে ভারতীয় নববর্ষ আর সেভাবে পালিত হচ্ছে না। অথচ প্রাচীন যুগের ভারতীয় প্রভাবে নববর্ষ পালিত হচ্ছে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায়। সম্ভবত এই একই প্রভাবে নেপালেও তা পালিত হয়। মুঘলদের প্রভাবে নয়, তারা তা পালন করছে আরো প্রাচীনকালের ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধদের প্রভাবে। এদের অনুসৃত বর্ষপঞ্জি হলো ‘বিক্রম সমভাত’।

খুব মজার কথা হলো এই যে, তামিলদের প্রথম মাসের নাম চৈত্র। ১৪ এপ্রিল দেখা যাচ্ছে সেখানে প্রথম চৈত্র হিসেবে পালিত হয়। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মনিপুর আর কেরালাতে বছরের শুরুটা হয় ১৫ এপ্রিল। ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসেবে পালিত হলেও, আসাম তা ‘বিহু উৎসব’ নামে পালন করে। অরুণাচলে নববর্ষ পালিত হয় ১৩ বা ১৪ এপ্রিল ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সাথে মিলিয়ে। অরুণাচলে এ উৎসবকে বলা হয় সংক্রান। লাওস, কমোডিয়া আর থাইল্যান্ডেও তা পালিত হয় সংক্রান নামেই। সংস্কৃত সংক্রান্তি থেকে সংক্রান শব্দটি এসেছে। মিয়ানমারে এই উৎসব পালিত হয় ‘থিনগায়ান’ নামে। নতুন বছরটি কেরালাতে পালিত হয় ‘বিশু’ নামে। উড়িষ্যায় পালিত হয় ‘পহেলা সংক্রান্তি’ নামে। বিহারে পালিত হয় ‘মিথিলা দিওয়াস’ বা ‘জুড়ে শীতল’ নামে। শ্রীলঙ্কার নববর্ষকে বলা হয় ‘সিনহালা’ সাথে ভিন্ন আরো নাম থাকতে পারে। উত্তর ভারতে বৈশাখী নামে এটা পালিত হলেও তেমন প্রভাব নেই এই উৎসবের। দিল্লি এবং উত্তর ভারতে, হিমাচল প্রদেশে ইংরেজি উৎসবই অনেকবেশি গুরুত্ব পায়।

বাংলাদেশ যেটা ভেবে থাকে, পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য সেটা নিয়ে তাহলে কিছুটা প্রশ্ন জাগে। পহেলা বৈশাখ ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালিরও নয়। পহেলা বৈশাখ নামেই তা নেপালে, ত্রিপুরাতে আর পাঞ্জাবে পালিত হয়। সে হিসেবে এটা শুধু বাঙালির ঐতিহ্য নয়, বাঙালিরা আরো অনেকের মতো এর অংশীদার। ফলে বিরাট ভারতের ঐতিহ্যের অংশ। আর মুঘলদের সময় থেকে এটা নতুন করে চালু করা হয়। স্বভাবতই বাংলাদেশে নতুন বছর হিসেবে পহেলা বৈশাখ পালন। পাঁচশো বছরের কাছাকাছি হবে, তার চেয়ে বেশি নয়। সেকারণেই এটা হাজার বছরের ঐতিহ্য নয়। মুঘল আমলেই এই বর্ষপ্রথা চালু হয়েছিল কিন্তু সেটা ছিল কৃষকদের চাষাবাদ শুরু করা, খাজনা শোধ করার সুবিধার জন্য।

পহেলা বৈশাখ যে বাংলায় মুঘল শাসনের পরেও কিছুটা প্রবলভাবে টিকে ছিল তার কারণ ইংরেজদের প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আগের নিয়মেই পহেলা বৈশাখের দিন জমিদারদের কাছে কৃষকরা সব খাজনা বুঝিয়ে দিতেন। জমিদারের কাচারিতে কৃষকদের ওপর অত্যাচার চলতো খাজনা ঠিক মতো শোধ করতে না পারলে। সে কারণে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, সেটা কৃষকদের জন্য খুব আনন্দের দিন ছিল এমন নয়। বরং ছিল শঙ্কিত হওয়ার দিন। জমিদার আর আমলাদের জন্যই আনন্দের দিন ছিল তা। ত্রিশে সংক্রান্তিতে সমস্ত পাওনা মিটিয়ে দিতো কৃষক আর পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন করতেন জমিদাররা।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘পুণ্যাহ’ বলা হয়ে থাকে। পুণ্যাহ কথাটা মুঘল আমলেই শোনা যায়। পুণ্যাহের দিন সব পাওনা যে একবারে পরিশোধ করা হতো তা নয়। বাকি থাকা খাজনাটাই সেদিন পরিশোধ করতে হতো। মুঘল আমলে নিয়ম ছিল, কোনো অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এই পুণ্যাহর দিনে কৃষকদের অনেক খাজনা মাফ করে দেওয়া হতো বা কৃষক কীভাবে তা পরিশোধ করবে তার একটা চুক্তি হতো। মুঘল আমলে পুণ্যাহ পালনের নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি নির্দিষ্ট দিনে পুণ্যাহ পালনের নিয়ম চালু হয়।

ইংরেজ শাসনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও খাজনা মাফ করে দেয়ার ব্যাপারটা ছিল না। পাওনা খাজনা যে কোনোভাবেই হোক পরিশোধ করতে হতো কৃষককে। না করতে পারলে জমি থেকে উৎখাত বা কারাগার, নানা ধরনের অত্যাচারের শিকার হতেন রায়তরা। মুঘল আমলের মতো কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না ইংরেজ শাসকরা। স্বভাবতই জমিদাররা কৃষকদের ওপর মমত্ব দেখাতেন না বা দু চারজন তা দেখাতে চাইলেও পারতেন না। কারণ জমিদার আর রায়তের মাঝখানে অনেক মধ্যসত্ত্বভোগী ছিলেন। 

ভূস্বামীরা রায়ত বা প্রজাদের নিয়ে এই পুণ্যাহ উৎসব পালন করতেন নিজেদের কাচারিতে। গানবাজনাসহ আরো নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদাররা পুণ্যাহর দিনে অন্য জমিদারের সাথে অনেক সময় প্রতিযোগিতা করতেন নিজের জৌলুস দেখাবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারিতে এই পুণ্যাহ উৎসব পালন করতেন। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উঠিয়ে দেয়া হলে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তার আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে ব্যবসায়ীরা তখন লেনদেন পরিশোধের জন্য হালখাতা উৎসব শুরু করে। ত্রিশে সংক্রান্তিতে সব পাওনা বুঝিয়ে দেবে, আর খোলা হবে নতুন হিসেবের খাতা, তারমানেই হালখাতা। হালনাগাদের হিসাব চালু হবে আবার। বাংলাদেশে এখন যে শহরগুলোতে বিরাট আকারে নববর্ষ পালিত হয়, সেটা খুব বেশি দিন আগেকার ঘটনা নয়। ইংরেজি নববর্ষ পালনের চেয়ে বাঙালিরা নিজেদের বছরটিকে ঘিরে যে একটি উৎসবের দিন পালন করছে, সেটা আনন্দের খবর। কিন্তু ভিন্ন দিকে কিছু মানুষ দিনটিকে পালন করতে গিয়ে নানাভাবে ইতিহাস বিকৃত করছে। 

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের যে দিনটিকে খুব ঘটা করে বাঙালির সংস্কৃতি বলে প্রচার করা হচ্ছে, সেই পহেলা বৈশাখ বাংলার কৃষকদের জীবনে সুখের ছিল না। কৃষকের জন্য সেদিনটা ছিল দুর্দিন। যতোই দুঃখ-কষ্ট থাক খাজনা দিতে না পারলে, সেদিনটা ছিল প্রজাদের জমিদারির কাচারিতে কারাবাসের বা অত্যাচারিত হবার দিন। পহেলা বৈশাখে যে উৎসব হতো জমিদার বাড়িতে তার খরচটা জোগাতে হতো দরিদ্র কৃষককে। এ ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধটি পাঠ করলে জানা যাবে বছরে কতরকম বাড়তি কর তাকে দিতে হতো জমিদারের জুলুমের কারণে। হিন্দু এবং মুসলমান দুই ভ্রাতৃপ্রতিম কৃষককে সেই অত্যাচারের শিকার হতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু জমিদারের কাচারিতে মুসলমান কৃষককে আরো একটু বেশি নিগৃহীত হতে হতো। রবীন্দ্রনাথের কাচারির নীচের ঘটনাটা তার উদাহরণ। 

রবীন্দ্রনাথ জমিদারীর দায়িত্ব নিয়ে প্রথম গেলেন শিলাইদহ। পুণ্যাহ উৎসবের সময় সেটা। তিনি তখনো জানতেন না তার জন্য কী ধরনের ঘটনা অপেক্ষা করছে। জমিদারের ভার নেবার প্রথম দিনেই সম্পূর্ণ নতুন পথে হাঁটলেন তিনি। পুণ্যাহের হুলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে কাছারি মুখর। জমিদার রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ নতুন ‘বাবুমশায়’ কাছারিতে নেমে এলেন। ধূতি পাঞ্জাবি চাদরে শান্ত সৌম মূর্তি। প্রথা মতো প্রারম্ভে আদি ব্রহ্মসমাজের প্রার্থনা এবং পরে হিন্দুমতে পূজা। পুরোহিত বাবুমশায়ের কপালে পরিয়ে দিলেন চন্দনের তিলক; কিন্তু হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত। রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়াতে পারেনি পুণ্যাহ উৎসবের ত্রুটির দিকটি। রবীন্দ্রনাথের চোখে যা ত্রুটি মনে হলো, বহুকাল ধরে সেটাই ছিল রীতি।

রবীন্দ্রনাথ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, যা করবার প্রথম আঘাতেই সেরে ফেলতে হবে। বুঝতে পারলেন, তিনি সংঘাতের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন। দ্বারকানাথের সময় থেকেই সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ-অনুযায়ী পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে থাকে ভিন্ন ভিন্ন আসনের বন্দোবস্ত। হিন্দুরা চাদর ঢাকা সতরঞ্চির ওপর একধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা এবং চাদর ছাড়া সতরঞ্চির ওপর মুসলমান প্রজারা অন্য ধারে। সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদমর্যাদা মতো বসেন পৃথক আসনে। আর বাবুমশায়ের জন্য ভেলভেটমোড়া সিংহাসন। 

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের জমিদারিতেও পুণ্যাহর দিনটা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। প্রথমে ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনা আর পরে হিন্দুমতে পূজা। কিন্তু পূর্ব বাংলার বিরাট জনসংখ্যা মুসলমান। মুসলমান প্রজাকে সেখানে সেই ব্রহ্মপ্রার্থনা আর হিন্দুদের পূজা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেই হতো কিন্তু হিন্দুদের সমান মর্যাদা নিয়ে নয়। মুসলমানদের সেখানে কীভাবে নিগৃহীত করা হতো? হিন্দুদের জন্য চাদর ঢাকা সতরঞ্চিতে বসার ব্যবস্থা আর চাদরছাড়া সতরঞ্চির ওপর মুসলমান প্রজারা। খুব স্পষ্ট করে পহেলা বৈশাখের দিন বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, মুসলমানরা সাধারণ হিন্দুদের চেয়েও নিম্নস্তরের। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই সেটা চলে আসছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেদিন নিয়মটা পাল্টে দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ দৃঢ়তার সাথে হঠাৎ ঘোষণা করলেন, পুণ্যাহ উৎসব এভাবে চলতে পারে না। পুণ্যাহ মিলনের দিন, পুণ্যাহ বিভেদ ভুলবার দিন। নায়েব গোমস্তারা চমকিত শঙ্কিত হলেন। কী ব্যাপার বাবুমশায় অসন্তুষ্ট কেন। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করতেই রবীন্দ্রনাথ জানালেন, পুণ্যাহের এই উৎসবে আসনের জাতিভেদ তিনি মানবেন না। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে তিনি পুণ্যাহ উৎসব করবেন না। চন্দনের তিলক দিয়ে বরণের পর রবীন্দ্রনাথের সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু তিনি বসলেন না। সদর নায়েবকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নায়ের মশায় পুণ্যাহ উৎসবে এমন পৃথক ব্যবস্থা কেন?’ বাবুমশায়ের প্রশ্নে বিস্মিত নায়েব জবাব দিলেন, ‘বরাবর এই নিয়মই চলে আসছে।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, না, শুভদিনে আর এসব চলবে না। সব ভিন্ন ভিন্ন আসন তুলে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল সবাইকে একইভাবে, একই ধরনের আসনে বসতে হবে। 

রবীন্দ্রনাথ বিষয়টা তার পরিবারের জমিদারিতে পাল্টে দিয়েছিলেন বলে, সর্বত্র সেটা পাল্টে যায়নি। যারা বলছেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য তাদের কাছে প্রশ্ন, কীসের ঐতিহ্য সেটা? বাংলার কৃষক-সাধারণের জমিদার বাড়িতে অপমানিত হওয়ার ঐতিহ্য নয় কি? ফলে সেই পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করতে পারে সেই জমিদারদের বংশধররা বা সুবিধাভোগীরা। সকল বাঙালির উৎসবের দিবস সেটা নয়। যদি কেউ বলতে চান, নতুন করে এই দিবসটা সকলের জন্য নতুনভাবে পালন করতে চান-তাহলে একথা বলা অবশ্যই বাদ দিতে হবে যে, এটা হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য। বলতে পারেন, অতীতের খারাপ ঘটনাকে বাদ দিয়ে নতুন করে সকল মানুষের জন্য দিনটিকে পালন করা হবে। নতুন ঐতিহ্য এটা, পুরানো ঐতিহ্যের সাথে এই উৎসবের সম্পর্ক নেই। বহুজন যারা বলতে চান, পহেলা বৈশাখ হিন্দুরীতি তারা সেটা কেন বলেন তা বুঝতে হবে। কারণ দিনটা ধর্ম নিরপেক্ষ ছিল না।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারী তার বড় উদাহরণ। ফলে পহেলা বৈশাখ পালন করতে হলে আজকের মতোই পালন করতে হবে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুভুতিকে আঘাত না করে। পহেলা বৈশাখ যেন হয় সকল বাঙালির মিলনের দিন। কিছুতেই যেন উৎসব পালনটা এমন না হয়, কিছু মানুষ মনে করে বসে এটা হিন্দুয়ানী। কিছুতেই যেন সেটা মুসলমানীর না হয়, না হয় হিন্দুয়ানীর। সকলের মিলবার রাস্তা যেন খোলা রাখা হয়। না হলে বিষয়টা ক্রমে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫