
১৯৭১-এ হত্যার পর কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যার পর এই পুকুরে ফেলে রাখা হয়। ছবি- রফিক মজিদ
৩০ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। এদিন শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর জগৎপুর গ্রামে পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৩৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। এতে আহত হয় অর্ধশত মানুষ, জ্বালিয়ে দেয়া হয় জগৎপুর গ্রাম। এতে ২০০'র বেশি বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও এই গ্রামে শহীদদের উদ্দেশে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর।
শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দুরে ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রাম। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক বাহিনী আর দেশিও দোসররা গ্রামটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললে গ্রামের মানুষ প্রাণ ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশেই রঙ্গবিলে। সেদিনের বর্বরোচিত হামলায় ৩৫ জনের প্রাণ গেলেও সেদিনের ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে আজো বেঁচে আছেন অনেকেই।
সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে গ্রামবাসী জানায়, সেদিন ছিল বাংলা ১৬ বৈশাখ, ৩০ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ৮ টা। জগৎপুরের সামনের সংকর ঘোষ গ্রাম থেকে স্থানীয় রাজাকার মজিবর, বেলায়েত, নজর ও কালামের সহযোগিতায় পাক বাহিনী জগৎপুরের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাক বাহিনীর তিনটি দল গ্রামের তিন দিকে গিয়ে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। এসময় গ্রামবাসী কোন কিছু না বুঝেই জীবন বাঁচাতে গ্রামের পেছনের দিকের রঙ্গবিলের দিকে দৌড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু বিলের মাঝখানে পানি থাকায় কেউ সাঁতরে আবার কেউ বিলের দুই পাড় ঘেঁষে পালাতে যায়। এসময় শুকনো জায়গা দিয়ে পালাতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ৩৫ গ্রামবাসী। শুধু গুলি করে গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাক সেনারা। তারা শূন্য গ্রামের বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। ঘটনার প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর পাক সেনারা চলে গেলে কিছু কিছু গ্রামবাসী ফিরে এসে দেখে তাদের বাড়ি-ঘরের স্থলে পোড়া গন্ধ আর ছাই ছড়া আর কিছুই নেই। এ অবস্থা দেখে অনেকেই চলে যায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে। আবার অনেকেই নাড়ির টানে পড়ে থাকে গ্রামেই। এদিকে হিন্দু-মুসলিম অনেকেই তাদের আত্মীয়দের লাশ গ্রামের একটি জঙ্গলের কাছে গণকবর দেয়। ওই গণ কবরের পাশেই বর্তমানে হিন্দুদের শ্মশান ঘাট রয়েছে। কিন্তু ওই গণ কবরের স্থানটি আজো স্মৃতি চিহ্ন না করার জন্য ক্ষোভ রয়েছে গ্রামবাসীর।
গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদের ছোট ভাই আলফাজ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পার্শ্ববর্তী একটি ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য গ্রামের কাছাকাছি আসলে তার মা অসুস্থর খবর শুনে গ্রামে ছুটে আসে। এসময় তার সাথে ছিল আরো এক মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের মাস খানিক আগে স্থানীয় রাজাকাররা তার ভাই ও ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গেলেও আজো তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
এবিষয়ে সাবেক জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, আমাদের ব্যর্থতার কারণে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছরেও জগৎপুরে আজো কোন স্মৃতিচিহ্ন তো দূরের কথা, শহীদদেরই নামে তালিকা তৈরি করা হয়নি। বিগত ৪ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে জগৎপুরে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণের প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও সেটি কি অবস্থায় আছে তা জানা নাই।
এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ জানায়, ওই গ্রামে বেসরকারি ভাবে একটি স্মৃতি ফলক তৈরির উদ্যোগের কথা শুনেছি। তারপরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারী ভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে। যাতে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ এবং শহীদদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়।