Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

জীবনমানের ব্যয়ে পর্যুদস্ত সাধারণ মানুষ

Icon

হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ২২:৪৯

জীবনমানের ব্যয়ে পর্যুদস্ত সাধারণ মানুষ

জীবনযাত্রার ব্যয়ে পর্যুদস্ত জনগণ। বিশেষ করে নিত্যআয়ে যাদের নিত্যব্যয় মেটে, তারাই নাকাল উচ্চ ব্যয়ের ফাঁদে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জীবনযাপনের জন্য যাবতীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের নিত্যব্যয় ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা জীবনযাপনের উচ্চ ব্যয়ে নাকাল হয়ে পড়েছেন।

সরকারি হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ২০.৫ শতাংশ। আগের বছর যা ছিল ২১.৮ শতাংশ। প্রতি বছর দারিদ্র্যের হার কমছে। দরিদ্র অবস্থা থেকে মানুষ মধ্যবিত্ত জীবনে প্রবেশ করছে। কিন্তু জীবনযাপনে তারা কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সংজ্ঞা অনুসারে, যেসব মানুষ দৈনিক ১০ থেকে ১০০ ডলার (৮৫০ থেকে ৮৫০০ টাকা) আয় বা ব্যয় করেন, তারাই মধ্যবিত্ত। অর্থনৈতিক বিচারে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে।

তাদের হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে এশিয়ায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ কোটি। আর ২০৩০ সালে বৈশ্বিক মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৯০ কোটি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। দুই দশক পরে মধ্যবিত্তের হার দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু যে সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই, সেই সমাজে মধ্যবিত্তকে সামাজিক মর্যাদা ঠিক রাখতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। এই শ্রেণির মানুষের জীবনযাপন দুঃসহ করে তোলে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জীবনযাপনের অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধির দৌরাত্ম্য।

জীবনযাপনের খরচ বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি নিজেদের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবার তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। রাজধানীর বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

রাজধানীর মানিকনগরের এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বছরের শুরুতে তার বাসাভাড়া ৭০০ টাকা বৃদ্ধি করেছে বাসার মালিক। আরেক বাসিন্দা জানান, তারা বাসাভাড়া ১ হাজার বাড়িয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

বাসাভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে উচ্চবিত্তের বাড়িভাড়া কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে বাড়ি ভাড়ায় বাড়তি টাকা গুনতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তির ঘরভাড়া। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮.১৮ শতাংশ, বস্তির ঘর ভাড়া ৯.৭৪ এবং মেসের ভাড়া ৭.৯১ শতাংশ বেড়েছে।

শহুরে জীবনের নিত্য অনুসঙ্গ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেল। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও প্রতিনিয়ত এই সেবার মূল্য বাড়ছে। গত এক দশকে বিদ্যুতে অভাবনীয় উন্নতি হলেও বাড়তি ব্যয়ে চালানো কুইক রেন্টালগুলো সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলেছে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৭ বার এবং খুচরা মূল্য ৯ বার বাড়ানো হয়েছে। সংকটের কথা বলে সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। নিম্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। সেই এলপিজি গ্যাসের মূল্য (১২.৫ লিটার) ১৭০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে তাদের রান্না তথা খাবারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

রান্নার অবিচ্ছেদ্য মসলা পেঁয়াজের দামে নাকাল মানুষ। গত বছর পেঁয়াজ ২৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। অথচ বছরের শুরুতে দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। সেই হিসাবে দাম বেড়েছে ২৫০ টাকা। গত ১৪ জানুয়ারির বাজারেও পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত।

সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয় উসকে দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ৮০-৮৫ থেকে ৯১-৯৩ টাকায় উঠেছে। ঠিক এক বছর আগে এর দাম ছিল আরও কম, ৭৮-৮৪ টাকা। পাম অয়েলের দাম বেড়ে এক মাসে ৬৫-৭০ থেকে ৮০-৮২ টাকা হয়েছে।

সুপার পাম অয়েলের দাম বেড়ে ৭০-৭৫ থেকে ৮৪-৮৫ টাকা হয়েছে। এদিকে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১০২ থেকে ১১০ টাকা করে সিটি গ্রুপ। অন্য মিলগুলোও তার পরপরই লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম কেজিতে ১৪ টাকা এবং ডালের দাম ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এভাবে মাছ, মাংস, দুধসহ যাবতীয় খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে। যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর বাইরে রয়েছে প্রতিদিনের যাতায়াত ব্যয়। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে গণপরিবহনের ভাড়া। লাগামহীনভাবে এসব ভাড়া বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও নেই। বেসরকারিভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। সেখানে প্লে থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মাসিক বেতনই ৪০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে রয়েছে বার্ষিক ভর্তি ফি এবং সেশন চার্জ। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি ফি এবং বেতন কম থাকলেও সেখানে শিক্ষার মান একবারে তলানিতে।

ওষুধের দামও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর সামন্য রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়েও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ নিমেষেই দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছেন। ক্যাবের তথ্যমতে, দেশে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক সম্প্রসারণ হওয়ার পরও সরকারের অনেক নামিদামি ব্যক্তি ঘটা করে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। এতে স্পষ্ট হয় দেশে চিকিৎসাসেবার মান এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তবে ব্যয় ঠিকই বেড়েছে।

এ ছাড়া প্রতি বছর অপ্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি কিনে বিপুল অর্থ অপচয় করছে সরকার, যেগুলো পর্যাপ্ত দক্ষ লোক না থাকায়, চিকিৎসকদের কম উপস্থিতি, অপ্রতুল ওষুধ সরবরাহ, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে দরিদ্র লোকজন কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অধিকাংশ নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬.০৮ শতাংশ। গত বছর যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তা আগের বছরের তুলনায় বেশি। এর আগের বছর ব্যয় বেড়েছিল ৬ শতাংশের মতো।

ক্যাব সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান বলেন, ‘পেঁয়াজ দিয়ে শুরুর পর একে একে চাল, ডাল, সয়াবিন তেলসহ নানা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীতকালীন সবজির দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এর প্রভাবে সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫