
টিপু হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন সুমন সিকদার ওরফে মুসা। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর শাজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন সিকদার ওরফে মুসা ওমানে আটক হয়েছেন।
তাকে দেশে ফেরত আনার জন্য ইন্টারপোলের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে ওমান পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
পুলিশের একটি দলের চলতি সপ্তাহেই ওমান যাওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশে এনসিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, ‘মুসা ওমানে আটক হয়েছেন। ওমানে ইন্টারপোলের এনসিবি শাখার সাথে আমরা যোগাযোগ করছি এবং অ্যাম্বাসির সাথেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারব বলে আশা রাখি।’
ওমানের সাথে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। দুই দেশের সম্পর্ক ও বিভিন্ন চুক্তির ভিত্তিতে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এআইজি মহিউল ইসলাম বলেন, ‘ওমানে মুসা বেশ কয়েক দিন ধরেই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ছিলেন।’
মুসা ওমানে কত তারিখে আটক হয়েছেন, তা জানা নেই বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তার।
মহিউল বলেন, ‘মুসা দুবাই থেকে ওমানের যাওয়ার আগেই ওমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তার ব্যাপারে তথ্য দেয়া ছিল। আমরা জানিয়ে রেখেছিলাম। দুবাই থেকে ওমান আসার পরপরই তিনি আটক হয়েছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের একটি টিমের ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে।’
গত ২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন গাড়িতে থাকা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিপু।
এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা ২৪ বছর বয়সী কলেজছাত্রী প্রীতি।
এ ঘটনার পরের দিন টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
মামলার পর ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। ২৮ মার্চ তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয় আদালত।
টিপু হত্যার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তারের পর গত ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। এতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, দীর্ঘদিন ধরে টিপু ও তার হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনেক পুরোনো বিষয়।
তিনি জানান, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরম্পরায় ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মিল্কী হত্যার তিন বছরের মধ্যে একই এলাকার বাসিন্দা রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, বোচা বাবু হত্যা মামলায় ওমর ফারুক, নাসির ও সালেহ চার্জশিটভুক্ত আসামি আর কাইল্লা পলাশ মামলাটির একজন সাক্ষী। এই মামলার বিচারকাজ প্রভাবিত করতে একই মামলার আরেক আসামি মুসার সাথে ওমর ফারুক, নাসির, সালেহ ও কাইল্লা পলাশ যুক্ত হয়ে টিপু হত্যার পরিকল্পনা করেন।
তিনি জানান, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর এই হত্যায় টিপুর সম্পৃক্ততা প্রমাণে নানাভাবে চেষ্টা করে আসছিল ওমর ফারুক, পলাশসহ একটি পক্ষ। এরপরও জাহিদুল ইসলাম টিপু মামলা থেকে অব্যাহতি পান। পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার ওমর ফারুক ও অন্য সহযোগীরা স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে টিপুর অন্যতম সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে ২০১৬ সালে হত্যা করেন।
র্যাব জানিয়েছে, বোচা বাবু হত্যা মামলার মূল আসামিরা টিপুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মামলাটিকে প্রভাবিত ও বাদীকে ভয় দেখানো যাবে বলে মনে করেন। সে অনুযায়ী বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি ওমর ফারুক টিপু হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার জন্য সন্ত্রাসী ও শুটার মুসাকে দায়িত্ব দেন ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। মুসা ও তার ভাই সালেহও বাবু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোট ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। এতে ৯ লাখ টাকার জোগান দেন ওমর ফারুক। বাকি ৬ লাখ টাকা দেন মুসা, সালেহ ও নাসির। গ্রেপ্তার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যান। দুবাইয়ে যাওয়ার সময় মুসা ৫ লাখ টাকা নিয়ে যান এবং হুন্ডির মাধ্যমে মুসাকে আরও ৪ লাখ টাকা পাঠানো হয়। বাকি ৬ লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়।
দুবাই পৌঁছে মুসা শুটার ভাড়া করাসহ ব্যাকআপ টিম দিয়ে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা সাজান। হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংগঠিত হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। আর নজরদারির কাজ দেয়া হয় ওমর ফারুক, নাসির ও পলাশকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ থেকে নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েক দিন ধরে মুসার কাছে তথ্য পাঠাতেন।
ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর নাছির চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। পরবর্তী সময়ে টিপু গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখেন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিককে জানান। এরপর আনুমানিক রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট পাওয়া কিলার টিপুকে হত্যা করে।