Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

নৌ খাতে নানা অব্যবস্থাপনা

হুমকির মুখে নিরাপত্তা

Icon

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২২, ০৯:৪৪

হুমকির মুখে নিরাপত্তা

প্রতীকী ছবি

বর্ষা মৌসুম চলছে। চলতি বছরে বড় দুটি নৌ দুর্ঘটনার পরেও এখনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করছে। দেশের ছয় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথজুড়ে রয়েছে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা। নৌ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং নৌমালিক ও নৌশ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কথা বলে নৌপথের নানা অব্যবস্থাপনার কথা জানা গেছে।

নৌপথে ডাকাতির কবলে পড়ে খোয়াতে হচ্ছে প্রাণ ও পণ্য। বছরে নৌযান মালিক-শ্রমিকদের চাঁদা গুনতে হচ্ছে ৫শ’ কোটি টাকা। গত ১২ বছরে মাত্র ৩শ’ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা গেছে। খনন না হওয়ায় নাব্য হারাতে বসেছে এবং নৌচলাচলের অযোগ্য হতে বসেছে গুরুত্বপূর্ণ ১২টি নৌপথ। অথচ নাব্য রক্ষায় নদীর তলদেশে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার হচ্ছে না। ফিটনেস না থাকায় নদীর মাঝপথে ডুবে যাচ্ছে নৌযান। প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রী সাধারণ। এমনকি গত ১০ বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি সরকারের নেওয়া ১০টি সিদ্ধান্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হলেও দেশে নৌচলাচলে এখনো সময়োপযোগী ও কার্যকর কোনো আইন নেই। বিষয়টিকে অত্যন্ত দুঃখজনক মনে করছেন নৌ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

১৯৭৫ সালের পর দেশে সামরিক শাসন চলাকালে অভ্যন্তরীণ জলসীমায় নিরাপদ ও দূষণমুক্ত নৌচলাচল নিশ্চিত করতে ‘দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর প্রায় ৪৭ বছর পেরিয়েছে। এরই মধ্যে সামরিক আইনকে বৈধতা দেওয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীও বাতিল হয়েছে, একের পর এক লঞ্চ দুর্ঘটনাও ঘটেছে; কিন্তু সামরিক শাসনামলের সেই আইন দিয়েই চলছে দেশের নৌপরিবহন। একের পর এক নৌ দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করতে পারেনি নৌপথের নতুন আইন।

এ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান বলেন, আমলাতান্ত্রিক কিছু জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয় নৌপথের নতুন আইন চূড়ান্ত করতে পারেনি। এটা সত্যি যে, আমাদের জন্য এটি দুঃখজনক। দুর্ঘটনা এড়াতে যাত্রী, মালিক, চালক সবাইকে সচেতন হতে হবে। 

নৌ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো জানায়, উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ঢাকা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চল মিলিয়ে বর্তমানে দেশের ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথের শতাধিক স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চলছে চাঁদাবাজি। বছরে ৫০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির পুরোটাই যাচ্ছে দরিদ্র মাঝি-মাল্লাদের শ্রম-ঘামে অর্জিত অর্থ থেকে। এর মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত থেকে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনকারী পাঁচ হাজার বাল্কহেড নৌযান ও কার্গো ভয়াবহ চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। একেকটি মালবাহী নৌযানকে সীমান্ত থেকে ঢাকায় পৌঁছতে ঘাটে ঘাটে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশে বাল্কহেড নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তফাজ্জল হোসেন বাদল জানান, নৌপথের অরাজকতা তাদের শঙ্কিত করে তুলেছে।

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ২০১৬ সাল থেকে যেসব লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৫৪ শতাংশই অন্য নৌযানের সাথে সংঘর্ষ ও ধাক্কা লেগে। বৈরি আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ এবং বাকি দুর্ঘটনাগুলো অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, লঞ্চের তলা ফেটে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, আগুন ও বিস্ফোরণের কারণে হয়ে থাকে।

অধিদপ্তর জানায়, দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে তা হয়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কিলোমিটারে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মালামাল ও যাত্রী পরিবহন ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ১০ হাজার ১৪৩টি জলযান নিবন্ধনের আওতায় এসেছে। আরও প্রায় ২০ হাজার ছোট নৌযান নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। এগুলো কোনো প্রকার তদারকি ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চলছে। তা ছাড়া সারাদেশে ৮৫০টি লঞ্চের ফিটনেস সার্ভে করেন হাতে গোনা কয়েকজন সার্ভেয়ার, যাদের পক্ষে আসলে সঠিক মনিটরিং সম্ভব না।

এ বিষয়ে নৌপথ ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. ইনামুল হক বলেন, টেকসই ও উন্নত নৌযান নির্মাণ এবং নৌপথ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। নিশ্চিত করা যায়নি নৌযানের ফিটনেস। ফলে প্রতিবছরই ঘটছে নৌ দুর্ঘটনা।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল হইতে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫০৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ হাজার ৬১০ জন।

বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক (নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ) ও নদী বিশেষজ্ঞ এমদাদুল হক বাদশা বলেন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় অনেক নৌযান শেষ পর্যন্ত নদীর তলদেশেই পড়ে থাকছে। যেমন- হামজা ও রুস্তমের মাত্র ৬০ টন ওজনের নৌযান উদ্ধার করার ক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু ডুবে যাওয়া নৌযানের মধ্যে রয়েছে একশ থেকে হাজার টন ওজনের অনেকগুলো জাহাজ।

লাইটার জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন বলেন, নিবন্ধিত লাইটারেজ জাহাজের সংখ্যা ৭শ’র বেশি। এর বাইরেও ৩শ’ জাহাজ পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করে। এসব জাহাজে কর্মরত শ্রমিক ১০ হাজার। চরম নিরাপত্তাহীনতায় নৌপথে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে জ্বালানি তেল, গমসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিতে হয় লাইটারেজ শ্রমিকদের। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে কোন জাহাজে রাখা যায় না সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী। পণ্য নিয়ে যাবার সময় তাদের পড়তে হয় ডাকাতের কবলে। আর সম্প্রতি এ ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে খুব বেশি। এ বিষয়ে প্রশাসন আশ্বাস দিলেও ডাকাতির ঘটনা বন্ধ হয়নি। অনেক সময় পণ্য নিয়ে যাবার সময় জাহাজ ডুবিতেও প্রাণ হারায় অনেক শ্রমিক। মালিকপক্ষ বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ পেলেও শ্রমিকদের কিছুই দেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী ও ভাড়া আদায়, ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সার্ভে সনদ ও রুট পারমিট প্রদান, অদক্ষ চালকসহ নানা কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। বাসের মতো লঞ্চেও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিন বা বডি নিয়ে অসংখ্য যাত্রীর জীবন নিয়ে খেলছেন লঞ্চ মালিক ও চালকরা। বছর বছর লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো হলেও যাত্রীসেবা ও যাত্রীদের নিরাপত্তা এখনো সেকেলে। এতে নৌপথে মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই অনেকটা দায়সারাভাবে গঠন করা হয় এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি। প্রতিটি তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ, দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধের উপায় বা প্রতিকার এবং কিছু সুপারিশ করলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখে না। আবার প্রতিটি কমিটি কোনো সমন্বয় ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় নানা বিষয়ে থাকে মতানৈক্য। এতে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। পড়েন। এই টানাপড়েনে শেষ পর্যন্ত কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন করা হয় না। যে কারণে পুনরাবৃত্তি ঘটে এসব দুর্ঘটনার।

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, মানসম্মত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত করার আশপাশেও আমরা নেই। যে কারণে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই আমরা একটা গ্রুপকে দোষারোপ করি অথচ প্রকৃতপক্ষে যারা দায়ী তারা এ কমিটি বলয়েই থাকেন। পরোক্ষভাবে যারা জড়িত তারাও থাকেন কমিটিতে। 

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, লঞ্চ মালিকদের অতিরিক্ত আয়ের লোভের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবেই নৌ পরিবহন খাতে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের লোকজন লঞ্চে আসেন না, পরীক্ষাও করেন না। তারা তাদের অফিসেই বসে থাকেন। লঞ্চটি চলাচলের উপযুক্ত কি-না, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হচ্ছে কি-না, তা সরেজমিনে দেখেন না। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ অফিসে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে চলে আসেন। অব্যবস্থাপনা ঠেকাতে এ বিষয়গুলোর প্রতি কঠোর হতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫