Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বাঙালির গর্ব পদ্মা সেতু

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২২, ০৮:৩৯

বাঙালির গর্ব পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

পদ্মা সেতু দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বড় প্রকল্প। প্রকল্পটি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, অর্থায়ন সরিয়ে নেওয়া, সমালোচনা আর রাজনৈতিক বাহাসে ঢের ঘোলা জল করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন সরিয়ে নেওয়ার দশ বছরের মাথায় সব বাধা পেরিয়ে নিজেদের অর্থেই সেতুটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। যদিও বিচার শেষে দুর্নীতির অভিযোগকে কানাডার আদালত ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজব’ বলে আখ্যায়িত করে। দেশি-বিদেশি লবিস্টদের কারণেই অর্থায়ন সরিয়েছিল বিশ্বব্যাংক এমনটাই দাবি সরকারের। 

রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করবে পদ্মা সেতু। যদিও নির্মাণের পথটা সহজ ছিল না এ সেতুর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০১১ সালে এ প্রকল্পে অর্থায়নে চুক্তি করে বিশ্বব্যাংক। সেতু নির্মাণে পরামর্শকের কাজ পায় কানাডার এসএনসি-লাভালিন। কাজ পেতে কোম্পানিটি বাংলাদেশের দায়িত্বশীলদের ঘুষ দিয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে তা প্রমাণের আগেই অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। এরপর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ ও সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারসহ নানা নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়। ওই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তাকেও সরে যাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল।

এ দিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সরানোয় ড. ইউনূসের হাত আছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছেড়ে কথা বলেননি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকেও। 

নানা সমালোচনা আর বিশ্ব মোড়লদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণ, দেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রমাণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক যে ধাক্কা খেয়েছে আশা করি, তারা তাদের স্বভাব পরিবর্তন করবে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশও অনুপ্রাণিত হয়েছে, এবং আমরা এমন কাজ ভবিষ্যতে আরো করতে পারব।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে গেলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির ঘোষণা দেয় সরকার। ২০১৫ সালে কাজ শুরু করে ২০১৮ সালে তা শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নদীশাসন, নকশায় পরিবর্তন, করোনাসহ নানা কারণে কয়েক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ঠেকে। 

পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলেরই নয়, পুরো দেশের স্বপ্নের একটি সেতু। তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়েছে এই সেতুকে। শুরু থেকেই এই সেতুর পথচলা মসৃণ ছিল না। সর্বপ্রথম ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা সেতুর সম্ভাব্যতা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি করান সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। 

২০০১ সালের অক্টোবরে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। কোনো অগ্রগতি না করেই ২০০৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২,০০০ কোটি টাকা। তবে সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী সর্বমোট নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকায় সীমিত রাখার পরামর্শ প্রদান করেন। আর এতে আরেক দফায় বন্ধ হয়ে যায় পদ্মা সেতুর উঠে দাঁড়ানোর পথ।

তারপর ক্ষমতা আসে সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন সরকার। ২০০৭ সালে তারা ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানানোর প্রকল্প পাস করেন; কিন্তু আর এগোয়নি সেই পদ্মা সেতুর কাজ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের সাথে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চুক্তি সই হয়। ১৮ মে জাইকার সাথে, ২৪ মে আইডিবির সাথে এবং ৬ জুন এডিবির সাথে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে; কিন্তু যেখানে টাকাই ছাড় করা হয়নি, দুর্নীতি করবে কীভাবে? তারপর কানাডার আদালত প্রমাণ করল কোনো দুর্নীতি হয়নি। আসলে এখানে যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে এটা কারও অজানা নয়। আবারও থেমে গেল পদ্মা সেতুর পথচলা। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের মন রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। যদিও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে ইস্তফা দিতে বললে তিনি ইস্তফা দেন। সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে বদলি করা হয়। প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান টিম গঠন করে। পরে সাত জনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়। এত সব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। তারা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ঋণচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে জাইকা, এডিবি ও আইডিবি ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। আবারও পদ্মা সেতুর উঠে দাঁড়ানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময় কানাডার আদালতে মামলাও করে; কিন্তু সেই সব মামলায় হেরে যায় বিশ্বব্যাংক। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ আদালত অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে মামলা খারিজ করে দেয় এবং অভিযুক্তরা খালাস পান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদের অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। প্রধানমন্ত্রী একটা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিলেন, পদ্মা সেতু আমাদের টাকায় হবে এবং বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা এটার তদারকির দায়িত্বে থাকবে। যেখানে আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব নেই, সেখানে আমরা কেন বিদেশিদের আনব। যেমন কথা তেমন কাজ।

শুরু হয় দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। আন্তর্জাতিক টেন্ডারে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড কাজ পায়। ১৭ জুন ২০১৪ তারিখে সেতু কর্তৃপক্ষ চায়না ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানিকে সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদার হিসেবে নির্বাচন করে।

তারা ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে নদীর মধ্যখানে পিলারে নদীর তলদেশের পরিবর্তনের কারণে পিলারের আবারও পরিবর্তন করতে হয়। বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মালামাল রাখার ইয়ার্ডে। পদ্মা সেতুর বেশ কিছু রেলওয়ে স্ল্যাব নদীগর্ভে হারিয়ে যায় সর্বনাশা পদ্মা নদীর ভাঙনে।

তারপর করোনা শুরু হলে কাজ আরো এক দফায় থমকে যায়। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সালে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ তম পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু।

এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুদান রয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। সেতু বিভাগকে আসল হিসাবে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দিতে হবে। এর সাথে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে। অর্থাৎ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২২ সালের এপ্রিলে পদ্মা সেতুতে কার্পেটিংয়ের (পিচ ঢালাই) কাজ শেষ হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫