Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

পদ্মার দুই পাড়ের শ্রমজীবী মানুষের কী হবে

Icon

জাকারিয়া পলাশ

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২২, ১৫:১৬

পদ্মার দুই পাড়ের শ্রমজীবী মানুষের কী হবে

পদ্মা সেতু। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

অর্থনীতিতে ‘উন্নয়ন উদ্বাস্তু’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। বিভিন্ন দেশে যখন ‘উন্নয়ন’-এর নামে বাঁধ, ব্রিজ, বন্দর ইত্যাদি মেগা প্রজেক্ট করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরা হলো ‘উন্নয়ন উদ্বাস্তু’। উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ তারা। 

যে কোনো উন্নয়নের পক্ষে সব সময়ই রাষ্ট্র ও সরকার উচ্ছ্বাসপূর্ণ বয়ান হাজির করে। উৎসবের আড়ম্বরতায় অশ্রুত থেকে যায় সর্বস্ব ত্যাগ করে দেওয়া ওই সব সম্প্রদায়ের দুঃখ দুর্দশার কথা। পদ্মার পাড়েও তেমন কিছু গল্প রয়েছে। 

প্রমত্তা পদ্মা নদীর দুই প্রান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা সংযোগে নির্মিত বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন ২০২২। সরকারি দল এরই মধ্যে উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করার পাশাপাশি দেশব্যাপী ব্যাপক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নানা কথা বলে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন। বিপুল উন্মাদনার প্রচারণায় সরব থাকার জন্য গণমাধ্যমকেও ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে। এ উদ্বোধনের মহাযজ্ঞের প্রাক্কালে ‘উন্নয়ন উদ্বাস্তু’ ও পদ্মা সেতুর কারণে শ্রমজীবী যে শ্রেণির রুটি-রুজির ব্যবস্থা সীমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে, সে সব মানুষের কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। 

ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই শ্রেণির মানুষ। এক শ্রেণি হলো, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য যাদের মালিকানাধীন ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আরেক শ্রেণি হলো, যারা মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটকে ঘিরে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাত্রীসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাতে সরকারি হিসাব বলছে, ‘এ সেতু প্রকল্পে সর্বমোট ২০ হাজার ৭৫৫টি পরিবারের মোট ১ হাজার ৪০৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাদেরকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করে পুনর্বাসন করার জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের আশপাশে ৭টি পুনর্বাসন এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব এলাকায় ৩ হাজার ১১টি প্লট তৈরি করে তা ৩ হাজার ১১টি পরিবারকে বিতরণ করা হয়েছে। এরা কেউ আড়াই শতক, কেউ পাঁচ শতক বা কেউ সাত শতক করে জমি পেয়েছেন।’ 

বাকি ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অন্যত্র চলে গেছেন। তাদের অধিগ্রহণকৃত জমির বিনিময়ে তারা কিছু অর্থ পেয়েছেন; কিন্তু সকলে জমির ন্যায্যমূল্য পেয়েছেন কিনা তা নিয়েও কিছুটা সংশয়ের অবকাশ রয়েছে? এরই মধ্যে দু-একটি অভিযোগ গণমাধ্যম সুবাদে জানা গেছে। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বয়োবৃদ্ধ আতাউল হকের ৫৪ শতাংশ ফসলি জমি পদ্মা সেতুতে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তার অভিযোগ, ফসলের জমি হলেও তার জমিকে গর্ত হিসেবে ধরে মূল্য নির্ধারণ করে কম অর্থ দেওয়া হয়েছে। 

তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্লট পেয়েছেন ঠিকই; কিন্তু তাকে শেষ বয়সে এসে বদল করতে হয়েছে জীবিকা। সারা জীবন কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। এখন তাকে কলোনির মধ্যে একটি দোকান চালাতে হয়, যা তার কাছে ভালো লাগে না। 

বৃদ্ধ আতাউল হকের জমির মূল্য প্রসঙ্গে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী বলেছেন, ‘জেলা প্রশাসক যখন কম টাকা দিয়েছে, তখন তিনি অভিযোগ করেননি। ফলে এখন নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আর জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে কোনো ভুল হলে সেটার দায়িত্ব সেতু বিভাগ নিতে পারবে না।’ বোঝা যায়, গরিব ও সাধারণ মানুষের ন্যায্য পাওনা এভাবেই আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ছুটতে থাকে। মাঝখানে গুমরে মরে প্রান্তজনের না পাওয়া সব বেদনা। আর এমন হাজারো মানুষের অব্যক্ত বেদনা হারিয়ে যায় মেগা প্রকল্পের বর্ণিল রাষ্ট্রীয় উদযাপনের ডামাডোলে। 

তবু জমির মালিকদের কম-বেশি অর্থ মিলেছে; কিন্তু ফেরিঘাটের দুই প্রান্তে দোকানপাট, লঞ্চ, স্পিডবোট, কুলি-শ্রমিকরা ব্রিজ উদ্বোধনের পর কর্মহীন হয়ে পড়বেন। তাদের জন্য সরকারের পুনর্বাসন পরিকল্পনা কী? সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। স্থানীয় নেতারা দোকানদারদের কিছুটা সান্ত্বনা দিয়েছেন এ বলে যে, সেখানে বিপুল মানুষ পর্যটনের জন্য যাবে। ফলে খাবারের দোকানগুলো চালু থাকবে; কিন্তু অনেকেই বলেছেন যে, ফেরিঘাটের আশপাশের দোকানপাট সরিয়ে আবার রাস্তার পাশে নিয়ে যেতে হবে। নতুন জায়গায় ফের দোকান স্থাপন করতে হবে, যা খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে সেগুলো করা হয়তো সম্ভব হবে না। তাছাড়া সেতু উদ্বোধনের পর কিছু দিন ব্যাপক দর্শনার্থীর আনাগোনা হলেও সেটা দীর্ঘমেয়াদে থাকার কথা নয়। ব্রিজে যে এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মিত হয়েছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিজের কাছাকাছি গাড়ি থামার প্রয়োজন খুব একটা হবে না। ফলে পর্যটন বা যাত্রা বিরতির মতো কোনো ব্যবস্থা হলেও তা হবে ভাঙ্গা মোড় অতিক্রম করার পর। 

এ প্রসঙ্গে মাওয়া এলাকার বাসিন্দা মো. উজ্জ্বল হোসেন বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়ে গেলে বেকারত্ব বাড়বে। আগে যেখানে প্রকল্পে এক হাজার থেকে দুই হাজার লোক কাজ করত। এখন ৫০-৬০ জন কাজ করে। এরই মধ্যে অনেকে বেকার হয়ে গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে ঘাটের যাত্রী কমে যাবে। যাত্রী কমে গেলে দোকান কমে যাবে, হোটেল কমে যাবে, কর্মচারী কমে যাবে। এখন ফেরি, স্পিডবোট ট্রলার চলে। তখন কেবল ফেরি চলবে। মানুষ বেশি সময় ব্যয় করে ফেরি দিয়ে যাবে না। টাকা বেশি লাগলেও ব্রিজ দিয়ে যেতে চাইবে। 

এ দিকে সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকার পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোকে নানা রকম প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা সেখানে সেলাই, কাপড়ের ব্লক, বাটিকের কাজ শেখাচ্ছে; কিন্তু সেখানকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা জানিয়েছেন, কাজ শিখলেও  সেসব কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা তারা জানেন না। কেননা তারা কোনো কুটির শিল্প পণ্য তৈরি করলে সেগুলো কোথায় বিপণন করা যায়, তার ব্যবস্থা তাদের জানা নেই। তাছাড়া পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা কোনো উদ্যোগও নিতে পারছেন না। 

এমতাবস্থায় এ বিপুল কর্মহীন মানুষের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করার বিষয়ে সরকারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। এ জন্য পদ্মা সেতুর কারণে সুযোগবঞ্চিত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় এবং তাদের তথ্য উন্মুক্ত করা প্রধান কাজ। সেই সঙ্গে এর মধ্যে কারা ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে তার পুনঃনিরীক্ষা করা প্রয়োজন স্বতন্ত্র সংস্থার মাধ্যমে। এর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে এসব মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার জন্য পদ্মা সেতুর ওপারে কলকারখানা স্থাপন করে, সেখানে তাদের কর্মসংস্থান করার উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও করেছেন অনেকে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫