পদ্মা সেতুর প্রথম ধাক্কায় অর্ধেকে নেমেছে লঞ্চ যাত্রী

খান রুবেল, বরিশাল
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২২, ১১:৫২

বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে লঞ্চগুলোতে যাত্রী কমেছে। ছবি : বরিশাল প্রতিনিধি
বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে লঞ্চের কেবিন মানেই সোনার হরিণ। একটি কেবিন পেতে অন্তত তিন-চার দিন আগে থেকে কাউন্টারে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। অথবা কেবিন নামের সোনার হরিণ ধরতে তদবির-লবিং চালাতে হতো উচ্চ পর্যায়ে। আর ডেকে জায়গা পেতে লঞ্চ ঘাটে আসতে হতো দুপুরের পর পরই।
কিন্তু বরিশাল নদীবন্দরের সেই চিত্র এখন ইতিহাসে রূপ নিচ্ছে। পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলের প্রথম ধাক্কাতেই অর্ধেকে নেমে এসেছে লঞ্চের যাত্রী। ঘাটে দাঁড়িয়ে হাকডাক মেরেও যাত্রী পাচ্ছে না লঞ্চগুলো। ফলে ডেক ও কেবিন অর্ধেক ফাঁকা রেখেই ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে বিলাসবহুল লঞ্চগুলো।
গত শনিবার (২৫ জুন) পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন গতকাল রবিবার (২৬ জুন) বরিশাল নদীবন্দরে এমন দৃশ্যই ফুটে উঠেছে। দেখা গেছে বন্দরে নোঙর করা ছয়টি বিলাসবহুল লঞ্চ পূর্বের তুলনায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যেতে। আর লঞ্চ স্টাফ ও শ্রমিকদের চোখে মুখে দেখা গেছে চিন্তার ভাঁজ।
যদিও পদ্মা সেতু লঞ্চ শিল্পের ওপর কতাটা প্রভাব ফেলবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মো. মুস্তাফিজুর রহমান। তার মতে পদ্মা সেতু উপভোগ করতে এখন সবাই সড়ক পথে আসা যাওয়া করছে। আগামী কয়েক মাস এমনভাবেই চলতে পারে বলেও ধারনা এই কর্মকর্তার।
তবে যাত্রীরা বলছেন, সড়ক পথে ভ্রমণ সহজ ও সময় সাশ্রয়ী হওয়ায় কিছু সংখ্যক যাত্রী কমতে পারে। অবশ্য ভাড়া কমানো হলে লঞ্চের যাত্রী পূর্বের মতোই থাকবে বলেও অভিমত তাদের।
বরিশাল নদীবন্দর সূত্রে জানা গেছে, রবিবার ঢাকার উদ্দেশে ছয়টি লঞ্চ বরিশাল নদীবন্দর ত্যাগ করেছে। লঞ্চগুলো হলো- এমভি এ্যাডভেঞ্জার-১, কুয়াকাটা-২, সুন্দরবন-১১, সুরভী-৭, পারাবত-১২ ও পারাবত-৯।
এ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চের যাত্রী আল আমিন বলেন, আমি সচারচার লঞ্চে যাতায়াত করি। ঢাকায় ব্যবসার সুবাদে বিগত ১০ বছর ধরে এই রুটে যাতায়াত করছি। তবে আজ এসে মনে হলো যাত্রীদের বেশ কদর করছে লঞ্চ স্টাফরা। পন্টুন ঘুরে শুনলাম সব লঞ্চেই কেবিনে যাত্রী খুঁজছে।
পারাবত-১২ লঞ্চের যাত্রী তানিয়া বলেন, আজকে অনেক যাত্রী কম। পুরো ডেক পূর্ণ হয়নি। আমরা পরিবারের চারজন ঢাকায় যাচ্ছি। কেবিনে ভাড়া কম নিয়েছে। এক সপ্তাহ পরে আবার বরিশালে ফিরবো। তবে তখন লঞ্চ নয়, সড়ক পথে আসবো। আসার পথে পদ্মা সেতু দেখবো।
কুয়াকাটা-২ লঞ্চের অপর যাত্রী ফিরদাউস বলেন, আগে ডাবল কেবিন দুই হাজার ৪০০ টাকার কমে বিক্রি হতো না। আজ এক হাজার ৮০০ টাকায় পেয়েছি। সিঙ্গেল কেবিন আগে এক হাজার ৪০০ টাকায় বেচলেও আজ এক হাজার টাকায়ও বিক্রি করছে। আবার যাত্রীদের খুব কদর করে লঞ্চে তুলছে। এটা পদ্মা সেতুর সুফল।
এদিকে, সুন্দরবন লঞ্চের ঘাট সুপারভাইজার মিলন বিশ্বাস বলেন, আমাদের আগেই আশঙ্কা ছিলো পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে লঞ্চের যাত্রী কমবে। তেমনটাই দেখছি। লঞ্চ মালিকরা যমনেই বলুক পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলের প্রথম দিনেই লঞ্চের যাত্রী অর্ধেকে নেমে এসেছে।
অপরদিকে, বরিশাল নদীবন্দরে নোঙর করা লঞ্চগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চের মোট ১৬৫টি কেবিনের মধ্যে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭৫টি। একইভাবে এমভি সুন্দরবন লঞ্চে ২৪০টির মধ্যে ২১৫টি, এমভি পারাবত-১২ লঞ্চের মোট ২৪০টির মধ্যে ১২০টি, কুয়াকাটা-২ লঞ্চের মোট ২৫০টি কেবিনের মধ্যে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭৮টি। আর সুরভী-৭ ও পারাবত-৯ লঞ্চের মোট কেবিনের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ কেবিন খালি গেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
এমভি কুয়াকাটা-২ লঞ্চের কাউন্টার ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, সড়কের সাথে লঞ্চের যাত্রীর সাথে তুলনা করলে চলবে না। লঞ্চের অধিকাংশ যাত্রী ২০০ থেকে ৩০০ টাকার। মানে তারা ডেকের যাত্রী। এই যাত্রী কখনোই বাসে যাবে না। তবে যাত্রী কমবে কিনা তা সামনে ঈদের পরে বোঝা যাবে। অবশ্য এটা সত্যি যে কেবিনের যাত্রী অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। সাধারণত এই সময়ে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকে বলে জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক ও নৌ নিরাপত্তা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক মুহা. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, লঞ্চে কিছু সংখ্যক যাত্রী কমতে পারে। তবে সেটা কেবিনের যাত্রী। ডেকের যাত্রী কমার সম্ভাবনা নেই। রবিবার থেকে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। এ কারণে যাত্রী কিছুটা কম হতে পারে। অনেকেই পদ্মা সেতু দেখার জন্য সড়ক পথে ঢাকা যাচ্ছেন।
তবে লঞ্চের যাত্রী ধরে রাখতে মালিকপক্ষ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা।