ফের বাড়ছে করোনা
চতুর্থ ঢেউয়ের আশংকা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২২, ১২:১৬

প্রতীকী ছবি
ফের বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। টানা তিন সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা। গত সাতদিনের নমুনা পরীক্ষার রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি। করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ফের কমিউনিটি সংক্রমণ শুরুর ইঙ্গিত বলে আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, সংক্রমণে এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহে দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হবে। এই সময় পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১৭ শতাংশের বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো দুই হাজার ১০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। সেইসাথে করোনা আক্রান্ত দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার (২৭ জুন) নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার ৮২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ।
করোনার চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলা করতে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। ভাইরাসটির নতুন ধরন দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়ায় উল্লেখ করে সবাইকে সতর্ক করে তিনি করোনার নতুন ধরন যথাযথভাবে মোকাবিলা করার জন্য দ্রুত কোভিডের টিকা গ্রহণের আহ্বান জানান।
করোনার নতুন ধরন দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়ায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় ১০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে বলে জানান এই ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘করোনার নতুন ধরন দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় ১০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। তবে সংক্রমণের হারে বৃদ্ধি পেলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
তবে করোনার চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলায় লকডাউনের মতো পদক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু বেপরোয়াভাবে চলাচল বা স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা যাবে না।
করোনার টিকা প্রসঙ্গে এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা প্রতিরোধে নাকে নেওয়ার ওষুধের ট্রায়াল শিগগিরই দেশে শুরু হতে পারে। বাংলাদেশ ও সুইডেনের যৌথ উদ্যোগে এই ওষুধ বাংলাদেশে তৈরি হবে। এই টিকা করোনার সব ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই প্রায় শতভাগ কার্যকর হবে এবং এটি মানুষকে অনেক বেশি সুরক্ষা দেবে।
তিনি আরো বলেন, শিগগির ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের করোনার টিকার আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টিও সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অভিমত অনুযায়ী ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের ফাইজারের টিকা দেওয়া হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বলেন, সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে তাতে বলা যায় আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যেই দেশে ফের কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হবে। এর শুরুটা হবে রাজধানী ঢাকায়। এরপর চট্টগ্রাম ও ধীরে ধীরে সারা দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে।
নমুনা পরীক্ষা অনেক কম হচ্ছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তা আরো বাড়াতে হবে। আক্রান্তদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া যথাসময়ে টিকা নিয়ে নিতে হবে। মাস্ক পরিধান করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে শারীরিক দূরত্ব। আর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, অনেকেই জ্বর, সর্দি-কাশিসহ করোনার অন্যান্য উপসর্গে ভুগলেও নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। এখন স্বাস্থ্য বিভাগের করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা অনেক বেশি। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলেই সহজে নমুনা পরীক্ষা করানো যায়। সাথে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করাতে হবে। জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি যে ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মানতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, দেশে কয়েকদিন ধরে করোনা সংক্রমণ ও শনাক্ত হার বাড়ছে। তবে করোনা শনাক্ত হওয়ার সংখ্যাটা আরো বেশি হবে। কারণ অনেকের উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা করাচ্ছেন না।
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডেও করোনা রোগী বাড়ছে। বুস্টার ডোজ নিয়েও মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশ এখন করোনার চতুর্থ ঢেউয়ে প্রবেশের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঢেউ কতটা ছোট রাখা যায় সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, একজন রোগী শনাক্ত হলে অন্তত পাঁচজন শনাক্তের বাইরে থাকে। এ হিসাবে অনেক সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্তের বাইরে রয়েছে। কিন্তু বড় একটি জনগোষ্ঠী টিকা নেওয়ায় মারাত্মক আক্রান্ত কম হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কম হচ্ছে। তবে যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দৈনিক মৃত্যু তিন থেকে পাঁচের ঘরে চলে যাবে। এটি প্রতিরোধে এখনই স্বাস্থ্যবিধি মানা ও টিকা নেওয়া জরুরি।
করোনার এই নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের বিষয়ে যবিপ্রবির উপাচার্য ও জেনোম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সাব-ভ্যারিয়েন্টটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একই বছরের মার্চে ডেল্টা ধরনের করোনায় আসে দ্বিতীয় ঢেউ। এ পর্যায়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় গত জুলাইয়ে। একপর্যায়ে শনাক্তের হার ৩৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।