Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মাছের চিকিৎসায় ‘বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল’

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২২, ১০:২৬

মাছের চিকিৎসায় ‘বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল’

প্রতীকী ছবি

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এক সময় খালে-বিলে, হাওর-বাঁওড়ে প্রচুর পরিমাণে শোল, গজার, বোয়াল, ভেটকি, পাবদা, টাকি, বউ, তপসি, গুলশা, কাচকি, খৈশা, কৈ, চিতল, টেংরা, আইড়, বাইন, পুঁটি, শিং, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলত।

এখন সেগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেছে! সেই স্থান দখল করে বাঙালিকে কোনো রকমে ভাতে-মাছে টিকিয়ে রেখেছে বিজাতীয়-রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ ইত্যাদি; কিন্তু বাণিজ্যিক চাষের অন্তত ২০ শতাংশ মাছই আক্রান্ত হয় নানা ধরনের রোগে। মড়ক লাগে। মার খায় উৎপাদন। মাছের তো আর হাসপাতাল নেই যে, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সেখানে! বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অবশ্য মাছের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে মাছের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার হাসপাতাল। তবে দেশের চাষিদের কথা চিন্তা করে এগিয়ে আসেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুদ রানা। একদল মৎস্য গবেষক ও বিশেষজ্ঞ নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল’। চাষিদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে কাক্সিক্ষত উৎপাদন বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাছ চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। তাই বর্তমানে পুকুর, নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ চাষ হয়; এমনকি ঘরের ছাদে বা ঘেরা জায়গায় বায়োফ্লক, হাই-ডেনসিটি এবং আরএএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব, রোগবালাই ও সঠিক দিকনির্দেশনা জানা না থাকলে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে চাষিদের অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। উৎপাদন হ্রাস পায়, যা মৎস্য খাত ও দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই চাষিদের আধুনিক কলাকৌশল শেখানো, সঠিক নির্দেশনা প্রদান, রোগবালাই নিরসন, মাছের মড়ক দেখা দিলে তার কারণ শনাক্ত করে সমাধান দেওয়াসহ চাষ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল।

এদেশে রয়েছে ১৩ লাখ পুকুর-দীঘি, যার আয়তন প্রায় ৩ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর। আরও আছে ১০ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর আয়তনের ২৪ হাজার কিলোমিটার নদ-নদী, ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টরের কাপ্তাই লেক, ১ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন এবং ২৬ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি। তবে দিন দিন কমে আসছে নদ-নদী, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক জলাভূমির আয়তন। তা সত্ত্বেও পরিচিত মাছের সংখ্যা কিন্তু বাজারে কম নয়, বরং বেশ চোখে পড়ার মতো। কখনো ভেবে দেখেছেন এই মাছগুলো বাজারে এলো কোথা থেকে? বাংলাদেশের মাটি, পানি ও জলবায়ু মাছ চাষের জন্য খুব উপযোগী। মাছ চাষ তুলনামূলকভাবে লাভজনক হওয়ায় চাষ পদ্ধতি ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তরের দিকে যাচ্ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এখন মাছ চাষ এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্য সম্পদের অবদান এখন চার শতাংশ। অবশ্য বর্তমানে ৫৬ শতাংশ মাছ আসছে পুকুর থেকে। আর পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণ। সেটা অবশ্য আরও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হতো, যদি না অধিক লাভের আশায় চাষি তার পুকুরে মাছের ঘনত্ব বাড়াত। আর সে কারণে প্রয়োগ করছে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে জলজ পরিবেশ নষ্ট হয়ে রোগজীবাণুর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে মাছ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় মহামারি আকারে প্রচুর মাছ মারাও যায়।

এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কম হয়, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন চাষি। আবার রোগ নিরাময়ের জন্য অনেকে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক, রাসায়নিক দ্রব্য বা কখনো নিষিদ্ধ দ্রব্যও (যা পরিবেশবান্ধব নয়) পুকুরে ব্যবহার করে। তখন নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস মাছ মানুষের জন্য আর নিরাপদ থাকে না। জলজ জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়।

রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা এসবিতে কর্মরত। পাশাপাশি একজন সফল মৎস্যচাষি। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কামারগাঁও গ্রামে তার মৎস্য খামার। মোট পাঁচটি পুকুরে মনোকালচার পদ্ধতিতে চাষ করছেন শিং মাছ। লাভের অঙ্কটা নেহাত কম নয়, সাত লাখ টাকা। ২২ লাখ টাকা খরচ বাদ দিয়ে এই লাভ করেছেন তিনি। তবে শুরুর অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর ছিল না রফিকুলের। একেকটি দুঃসংবাদ নিয়ে প্রতিটি ভোর হাজির হতো তার কাছে। অজানা কারণে মাছে মড়ক লাগত। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিল শত শত শিং। স্বপ্নের খামার বাঁচাতে যার কাছ থেকে যে পরামর্শ আসছিল, তা-ই গ্রহণ করছিলেন। লবণ, পটাশ, চুন, নানা রকম ওষুধ-কোনো কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। সবশেষ অসুস্থ মাছ নিয়ে হাজির হন মৎস্য হাসপাতালে। সামান্য ওষুধ এবং শেখানো কিছু কৌশল দূর করে দেয় তার কপালের ভাঁজ। এরপর আর কোনো ভুল হয়নি, নিজেই এখন মাছের চিকিৎসক।

বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণমূলক সংগঠন। দেশের পাঁচটি বিভাগে আমাদের কার্যক্রম চলমান। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে সার্ভিস বুথ ও প্রতিনিধি। পর্যায়ক্রমে আমরা পুরো বাংলাদেশে এই সেবা ছড়িয়ে দিতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালের মাধ্যমে আমরা চাষিদের মাছ চাষের কলাকৌশল, রোগ নিরাময়ের পূর্বপ্রস্তুতি সর্ম্পকে প্রশিক্ষণ দেই। আমাদের উপজেলা প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে চাষিদের পুকুর ও জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করে আধুনিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও হটলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে চাষিদের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেবা চালু রয়েছে। এ ছাড়াও বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি, আরএএসসহ যাবতীয় আধুনিক মাছ চাষ সম্পর্কে আগ্রহীদেরও প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয় হাসপাতালের পক্ষ থেকে।’ শুধু চিকিৎসাই নয়, মাছের রোগ নির্ণয় ও নিরাময় সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাসপাতালটি গবেষণার কাজও করে বলে জানান মৎস্য বিশেষজ্ঞ মাসুদ রানা। 

শেকৃবির এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশে মৎস্য হাসপাতাল খোলার উদ্দেশ্য হলো, উদ্যোক্তা ও মাছ চাষে আগ্রহীদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করা। এরই মধ্যে মাছের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় ক্ষুদ্র ও দুস্থ চাষিদের মধ্যে নিয়মিতই মাছের পোনা বিতরণ করা হচ্ছে। চাষির মেধাবী সন্তানদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় উচ্চশিক্ষায় বৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়। তাছাড়া মাছ চাষ করতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন রোগবালাই, পরিবেশগত সমস্যা, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। এই হাসপাতালের মৎস্য গবেষক বা সম্প্রসারণকর্মী না জানলেও একজন কৃষক তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ঠিকই এ ধরনের সমস্যার সমাধান জানেন। তখন তিনি এগিয়ে এসে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবেন। এভাবে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একে অপরের উন্নয়নের চালক হব।’ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল তাদের কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়াতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া ও জয়পুরহাট; ঢাকার গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ; ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও জামালপুর; রংপুর বিভাগের রংপুর ও দিনাজপুর এবং চট্টগ্রামের ফেনী জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মৎস্য হাসপাতালের মোট ৬৮টি সার্ভিস বুথ চালু রয়েছে। সেখান থেকে সেবা পাওয়া একাধিক মাছ চাষি বলেন, যে কোনো সমস্যায় মৎস্য হাসপাতালের প্রতিনিধিদের পাশে পাওয়া যায়। তারা পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের সাহায্য করেন। মাছের রোগ চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেন। ফলে মাছের রোগবালাই ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা অনেকাংশেই কমে গেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫