পথশিশুরা নেশার ধূম্রজালে হারিয়ে ফেলছে শৈশব ও কৈশোর

মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২২, ১৩:৫৩

প্রতীকী ছবি
রাজধানী ঢাকা শহরসহ সারাদেশে ভাসমান শিশুদের সংখ্যা বাড়ছেই। তাদের পিতা-মাতার কোনো পরিচয় এবং নির্দিষ্ট থাকার জায়গা নেই। শহরের ফুটপাতে বা পার্কে কিংবা রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটে থাকে তারা। পথশিশুরা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় না; তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়। বিভিন্ন অপরাধের বাহক হিসেবে তাদেরকে ব্যবহার করা হয়।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও শহরের রাস্তায় এদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। লাঞ্ছনার শিকার এসব পথশিশু শুধু নিজেদেরই নিঃশেষ করে দিচ্ছে না; অনেক সময় বৃহত্তর সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব শিশুর পুনর্বাসনে সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পথশিশুদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের অনেক অবহেলা রয়েছে। সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও দেখভালের অভাবে এসব শিশু জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ ও শিশুশ্রমে, যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত।
একটি গবেষণায় জানা যায়, পথশিশুরা মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেশব্যাপী পথশিশুদের উপর ওই গবেষণা চালায়। এক হাজার ৬০০ পথশিশুর উপর জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৯২৮ শিশু স্বীকার করেছে, তারা মাদক সেবন করে। আর ৫৮ শতাংশ শিশু মাদকসেবী। ৫৩ শতাংশ বলেছে, তারা মাদক সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সরাসরি মাদক কেনে। ১৪ শতাংশ বলেছে, ১০ বছর বয়স হওয়ার আগে থেকেই তারা মাদক গ্রহণ করছে। এদের মধ্যে আবার ৩৩৬ শিশু জানিয়েছে, তারা মাদকের বাহক হিসেবে কাজ করে। এসব তথ্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, পথশিশুদের কীভাবে মাদক কারবারিরা ব্যবহার করছে। তারা শুধু পথশিশুদের ধ্বংস করছে না, তাদের সাহায্যে সমাজে মাদকও ছড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণাটির ফল প্রকাশ হয় ২০২১ সালে। জরিপকাল ছিল এর আগে। অথচ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে এ সময়ে প্রায়ই মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে। ২০১৮ সালে মাদকের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সবচেয়ে বড় অভিযান চালানো হয়। এমনকি মাদক ব্যবসার অভিযোগে অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যারও শিকার হয়েছে।
মাদকের মূল কারবারিদের যে স্পর্শ করা হয়নি তা নিশ্চিত। বরং নিরাপদে পথশিশুদের সর্বনাশ করছে। মাদক কারবারিরা জাতির বড় ধরনের ক্ষতি করছে। জরিপে পথশিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ-অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আরও কিছু তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, এদের ৫৫ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থ। ৬৪ শতাংশ নিজেকে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে না। এরা আবার সস্তা এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষতিকর মাদক গ্রহণ করে। ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ক্যান্ডি সেবন করে। এসব সেবনের আরও কারণ হচ্ছে, এমন মাদকে ক্ষুধা মন্দা হয়। সোজা কথায় খাবার কেনার সামর্থ্য না থাকায় ক্ষুধার অভাব মাদক দিয়ে মেটাচ্ছে। আরেকটি কারণ, নিজেদের লাঞ্ছিত জীবন ভুলে থাকতে মাদক সেবন করছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি করা হচ্ছে। মাথাপিছু আয় গণনা করা হচ্ছে প্রায় তিন হাজার ডলার। পথশিশুদের ভাগ্য কোথায় সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। একটি পথশিশুর খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থানের জন্য তিন হাজার ডলারের প্রয়োজন নেই। সামান্য অর্থ ব্যয় করে এদের পুনর্বাসন করা যায়। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে পথশিশুদের পুনর্বাসন চলছে। তা যে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এটি রাস্তায় পথশিশুদের সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়। আমরা কোনোভাবে এসব শিশুকে লাঞ্ছনার জীবনে ফেলে রাখতে পারি না। তাদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হলে বোঝা যাবে আরও বিস্তারিত তথ্য। সরকার ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এমন একটি গবেষণা হওয়া সময়ের দাবি। তারপর এদের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেন একটি শিশুও হেলায় হারিয়ে না যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশটির সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, দেশটিতে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকাতে। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলেছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা দশ লাখের বেশি। ঢাকার হিসাব অবশ্য তাদের কাছে নেই।
ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা আরিফা এস শারমীন বলেছেন, সঠিক হিসাব বলা কঠিন। তবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে যেসব তথ্য আসে, তাতে দেখা যাচ্ছে, পথশিশুদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার বিপদসীমা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই।
সরেজমিনে ঢাকার চানখারপুল এলাকায় দেখা যায়, সারি সারি দোকান। এসব দোকানি পথশিশুদের কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ ইত্যাদি কিনে নিচ্ছে। এসব দোকানের আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছে মাদক বিক্রেতারা। এমনকি প্রতিবেদককেও ক্রেতা মনে করে মাদক বিক্রি করার চেষ্টা চালায়। ঢাকার পথশিশুদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ড্যান্ডি। তারপরই রয়েছে গাঁজা, ইয়াবা, প্যাথিড্রিন ইত্যাদি। এমনকি অনেক শিশু হেরোইনেও আসক্ত।
ইউনিসেফ কর্মকর্তা শারমীন আরও জানান, পথশিশুদের কাছে মাদক বিক্রির জন্য একটা সিন্ডিকেট কাজ করে। ভাঙারি ক্রেতারাই শিশুদের কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনে নেয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের হাতে মাদক তুলে দেয়।
গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের পথশিশুদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মাহবুব উদ্দীন আহমেদ।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, পথশিশুদের মধ্যে শৈশবে নানা পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ইত্যাদির শিকার হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাই বেশি। কিছু শিশুর জন্মই হয় পথে, তাদের অতি-দরিদ্র বাবা-মা ভাসমান থাকার কারণে। এদের বেশিরভাগই বিপথে থাকা বড়দের কবলে পড়ে মাদকাসক্ত হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মাদকাসক্ত একটা শিশুকে দিয়ে যে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। রাষ্ট্রের তাদের ব্যাপারে একেবারেই কোনো উৎসাহ নেই।
তার ভাষায়, এরা ভোটার নয়। তাই রাজনৈতিকভাবে এসব শিশুর কোনো মূল্য রাষ্ট্রের কাছে নেই। সামাজিকভাবেও এরা বিবর্জিত গোষ্ঠীর সন্তান। ফলে সমাজও তাদেরকে এড়িয়ে চলতে চায়।
অবশ্য সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ বা সিএসপিবি নামে একটি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্পের পরিচালক ওমর ফারুক জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের কিছু ড্রপ ইন সেন্টার রয়েছে, যেখানে আসক্ত শিশুদের এনে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদিও এই উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় একদমই যথেষ্ট নয়, তাও স্বীকার করে নেন তিনি।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণা মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি মাদকের স্পট আছে। এসব স্পটে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে।
প্রতিবছরের বাজেটে সরকারের একটি নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে পথশিশুদের নিয়ে। আছে সরকারি পুনর্বাসনকেন্দ্রও; কিন্তু পথশিশুদের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। তারা রয়ে যায় পথের ধারেই। নেশার ধূম্রজালে হারিয়ে ফেলে শৈশব ও কৈশোর।
এ ছাড়াও দেশে বহু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও কাজ করছে শিশুদের নিয়ে। তাদের এই কাজ কেন এই ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন করছে না? শুধু পুনর্বাসনই নয়, প্রয়োজন এই মাদকের বিস্তার রোধ। যারা এ মাদককে খুব সূক্ষ্ম কৌশলে সমাজের এই ছিন্নমূল শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।